ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুল আলম

সন্ত্রাস মুক্তির পথ নয়

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৪ মার্চ ২০১৭

সন্ত্রাস মুক্তির পথ নয়

ইসলামী খেলাফতের নামে কিছু জঙ্গীবাদী সংগঠন সাম্প্রতিককালে যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তার হাওয়া কিছুটা হলেও বাংলাদেশে লেগেছে। তাই এ বিষয়ে আমার মতামত, একজন সামান্য বাঙালী মুসলমান হিসেবে তুলে ধরছি। আপনি যদি আমার সঙ্গে একমত হোন, তবে ধন্যবাদ। যদি একমত নাও হোন, তবুও ধন্যবাদ এ জন্য যে, আপনি আমার মতামতটি পড়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হব, যদি আপনি আমার সমালোচনা করেন। আমার ধারণা, গঠনমূলক আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমেই কেবল সঠিক ও যুক্তিযুক্ত চিন্তাধারা বের হওয়া সম্ভব। ধৈর্যসহ প্রত্যেকের মতামত শোনাই হচ্ছে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সভ্যতা। আমার মতামতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের অধিকার আপনার অবশ্যই আছে এবং এ জন্য আমি আপনাকে সম্মান করি। আশা করি, আপনিও আমাকে আমার মতামত প্রকাশের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেবেন। এই যে ভিন্নমত পোষণের অধিকারের কথা আমি বলছি, তা যুগে যুগে ও কালে কালে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তি ও তর্কের শেষে আমাদের বলা উচিত, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না বলে দুঃখিত, কিন্তু আপনার মতামতকে আমি সম্মান করি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, এতে পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে স্থায়ী গণতান্ত্রিক ভিত্তি তৈরি হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিম-লে, এভাবে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা খুবই প্রয়োজন। এর কোন বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মানে শুধুই ভোট দেয়া-নেয়া নয়, পরমতসহিষ্ণতাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিভূমি। সবাইকে এটা মানতে ও চর্চা করতে হবে। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগের ও পরের জাতীয়মাপের নেতারা (ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল হাশিম প্রমুখ) অনেক বিষয়েই একমত হননি, কিন্তু পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ ও সৌহার্দ্য সকল সময়েই বজায় রেখেছেন। আজকের বাংলাদেশে এর বড় অভাব! ইসলামের একদম শুরুতে, যখন খুব কম লোকই নবী করিমের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে তখন আল্লাহ ওহি পাঠিয়েছেন ধৈর্যসহকারে আল্লাহর বাণী ব্যাখ্যা করার জন্য। যদি কেউ বিশ্বাস না করে, তা হলে বলতে হবে তোমার জন্য তোমার ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম। ধর্ম হচ্ছে মানুষের মনের বিষয়, জোর করার বিষয় নয়। এটাই ধর্মের জন্য পবিত্র কোরানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ্কে বিশ্বাস না করে, নাস্তিক হয় বা মূর্তিপূজক হয়; তা হলে তার কৃতকর্মের জন্য সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবে। অন্য কেউ তার বিচার করতে পারে না। সেই অধিকার স্বয়ং আল্লাহ্ নিজের হাতে রেখেছেন। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, কোন নবীকেও তিনি সেই অধিকার দেননি। তাই যদি কেউ এই বিচারের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়, তা হবে আল্লাহ্র নির্দেশের সুস্পষ্ট বরখেলাপ ও সীমা লঙ্ঘন। পবিত্র কোরানে আল্লাহ্পাক পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না। মুসলমান হিসেবে আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে, যাতে আমরা কেউ সীমা লঙ্ঘন না করি। এর অন্যথা হলে স্বয়ং আল্লাহ্র হাতে আমাদের চরম শাস্তি পেতেই হবে। একজন মানুষ কিভাবে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বা করে না, এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আবার কেউ যদি নাস্তিকও হয়, তার জন্য কোন শাস্তি বিধান আমরা করতে পারি না। তাই এটা মনে করা মারাত্মক ভুল যে, কেউ নাস্তিক হলে তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ, যাকে নাস্তিক বলে মনে করা হচ্ছে, সে সত্যি নাস্তিক কিনা বা কতখানি নাস্তিক, তা একমাত্র স্বয়ং আল্লাহ্ জানেন। আমরা জানি না। সেই সীমা না মেনে, ভুলভাবে তথাকথিত ইমানি দায়িত্ব পালনের নামে কাউকে হত্যা করা হলে; সে হত্যার দায় হত্যাকারীর একান্ত নিজস্ব। ইসলাম সর্বদা মধ্যপথের ধর্ম। এতে সব ধরনের অসহিষ্ণুতা ও জঙ্গীবাদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাই মদিনা বিজয়ের পর, নবী করিম যে নগর-শাসনের রূপরেখা তৈরি করেন; তাতে সব ধর্মের অনুসারী ও মূর্তিপূজকদেরও সুরক্ষা তিনি দিয়েছিলেন। তখন মদিনায় ইহুদী, মূর্তিপূজক সব বিশ্বাসের নাগরিক ছিল। তিনি কাউকেই ধর্ম বিশ্বাসের জন্য শাস্তি দেননি এবং যুক্তিযুক্তভাবে ‘তোমার জন্য তোমার ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম’ কোরানের এই মহান নির্দেশ মেনে; দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত পৃথিবীতে নবী করিমের এই নগর–শাসন রূপরেখা এতটাই সফল ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে যে, বারো শ’ বছর পরে যখন মুক্ত যুক্তরাষ্ট্র শাসনের সংবিধান রচনার প্রয়োজন হয় তখন মদিনা-শাসন রূপরেখা ছিল অন্যতম প্রধান উৎস। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে বিখ্যাত, তার অন্যতম কারণ হলো সব ধর্মের স্বাধীনতা। এটা এসেছে মদিনা-শাসনের রূপরেখা থেকে। বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রে তাই কোন ধর্মের অনুষ্ঠানে, প্রয়োজনে রাষ্ট্র সকল শক্তি নিয়োগে প্রার্থনাকারীদের সুরক্ষা দিতে সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। ট্রাম্প যতই লম্প-ঝম্প করুন না কেন, ওনার হাত-পা বাঁধা আছে সংবিধানের মাধ্যমে। যার ভিত্তি রচনা করে গেছেন পবিত্র ইসলামের নবী করিম, চৌদ্দশ’ বছর আগে। ইসলাম ও গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে পরমতসহিষ্ণুতা এবং এর ভিত্তিতে বাংলাদেশে ও সারাবিশ্বে জঙ্গীবাদের বদলে ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার আলোকে বৃহত্তর শান্তিপূর্ণ সমাজ ও সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। শুরুতেই বলেছি, গণতন্ত্রের মূলকথা শুধু ভোট দেয়া-নেয়া নয়। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। শুকনো মাটিতে যেমন হাজার বীজ বপন করলেও তার অঙ্কুরোদগম হবে না। তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষার আলোকে পরমতসহিষ্ণুতা-শুদ্ধবোধের চর্চা না করলে ইসলাম ও গণতন্ত্র কোনটাই কায়েম হবে না। মুক্তবুদ্ধির মানুষ হত্যা, জ্বালাও পোড়াও, অবরোধ-হরতাল চর্চা করলে সাধারণ মানুষের কষ্টই শুধু বাড়বে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের, যতশীঘ্র সম্ভব এই উপলব্ধি হবে ততই মঙ্গল। ংযধসংধষধস@ংনপয়ষড়নধষ.হবঃ
×