ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৩ মার্চ ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন জ্ঞানরাজ্যে অনন্য কিংবদন্তি অনন্য মহা পুরুষ। তিনি ছিলেন : চল্লিষ্ণু বিদ্যাকল্পদ্রুত অর্থাৎ চলন্ত বিশ্বকোষ, পৃথিবীর তাবত জ্ঞানরাজ্যে তিনি অবাধে বিচরণ করেছেন, ২৪টি ভাষা তার আয়ত্তে ছিল, ১৮টি ভাষার ওপর তার অসাধারণ পা-িত্য ছিল। পৃথিবীর নানা ভাষা নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ভাষাবিজ্ঞানের দুরূহ অঙ্গনে তার বিচরণ ছিল বিস্ময়কর। তার মাতৃভাষা প্রীতিই তাকে পৃথিবীর নানা জাতির মাতৃভাষার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তিনি প্রমাণ করেন বাংলাভাষা সংস্কৃতি ভাষার দুহিতা নয়। তিনি বাংলা ভাষাকে তদান্তীন ব্রিটিশ ভারতের জাতীয় ভাষা এবং পরবর্তীকালে ভারত ভেঙ্গে মুসলমানদের আলাদা বাসভূমি হিসেবে উদ্ভাসিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করবার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। বাংলাভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার একাডেমিক আলোচনা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকেই। বিশেষ করে মাওলানা আকরাম খাঁ, ফুরফুরা শরীফের পীর মজাদ্দিদে যামান হযরত মাওলানা আবূ বকর সিদ্দিকী (রহ) বিশিষ্ট সাংবাদিক-লেখক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ডাক্তার লুৎফর রহমান প্রমুখ সচেতন ব্যক্তি বাংলাভাষার পক্ষে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব তো বাংলাভাষায় মিলাদ মাহফিল পরিচালনা, ইল্মে তাসাউফের তালিম-তালকিন প্রবর্তন করেন। তার বিশিষ্ট মুরিদ ও খলিফা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন : বাংলাভাষা চাই-ই। মুহম্মদ-ই-বখতিয়ারের বাংলা জয়ের পরে যখন মুসলমান বুঝিল এই চির হরিতা ফল শস্য পুরিতা নদ-নদীভূষিতা বঙ্গভূমি জয় করে ফেলে যাওয়ার জিনিস নহে, এ দেশ কর্মের জন্য, এ দেশ ভোগের জন্য, এ দেশ জীবনের জন্য, এ দেশ মরণের জন্য, তখন হইতে মুসলমান জানিয়েছে বাংলা চাই। তাই বাংলার পাঠান বাদশাহ্গণ বাংলা ভাষাকে আদর করিতে লাগিলেন। যে ভাষা দেশের উচ্চ শ্রেণীর অবজ্ঞাত ছিল, যা বাদশাহ্র দরবারে ঠাঁই পেল। নসরৎশাহ, হোসেন শাহ্, পরাগল খাঁ, ছবি খাঁর নাম বাঙালী ভুলিতে পারিবে না। বাদশাহ্র দেখাদেখি আমির ওমরাহ্ বাংলার খাতির করিলেন। আমির ওমরাহ্ দেখাদেখি সাধারণে বাংলার আদর করিল : গোঁড়া ব্রাহ্মণের অভিসম্পাত ও চোখ রাঙানিকে ভয় না করিয়া বাঙালী নবীন উৎসাহে তাহার প্রিয় ধর্ম পুস্তকগুলোকে বাঙালায় অনুবাদ করিল, কত দেশ প্রচলিত ধর্মকথা বাঙালায় প্রকাশ করিল, মর্মগাথা বাঙালায় প্রচার করিল। মুসলমানও চুপ করিয়া থাকে নাই। হিন্দুর রামায়ণ আছে, মুসলমানের জঙ্গনামা আছে হিন্দুর মহাভারত আছে, মুসলমানের কাসাসোল আম্বিয়া আছে, হিন্দুর মহাজন পদাবলি আছে, মুসলমানের মারফতি আছে, হিন্দু বিদ্যা সুন্দর আছে, মুসলমানের পদ্মাবতী আছে। এই পুঁথি সাহিত্যকে ঘৃণা করিলে চলিবে না।... যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়ত পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকে ভাষা হইত। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় ভাষা কি হওয়া উচিত তা নিয়ে এক সেমিনারে তিনি নানা যুক্তি প্রমাণ উত্থাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাই যে ভারতের জাতীয় ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে তা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে আসন্ন পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা উচিত হবে বলে এক প্রবন্ধে তার মতামত ব্যক্ত করলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন : বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হলে এটা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হবে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বগুড়ার আযীযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এই সময় বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের এক বিশাল মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে কয়েক ছাত্রের শহীদ হওয়ার খবর শুনে তিনি শোকে কাতর হয়ে পড়েছিলেন এবং নিজের কালো শিরওয়ানি কেটে কালো ব্যাজ বানিয়ে বুকে ধারণ করেছিলেন। ডক্টর সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন : শহীদুল্লাহ্ সাহেব ঐঁসধহরঃরবং বা মানবিকী বিদ্যায় অর্থাৎ ভাষা সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম-দর্শন, আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাৎ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি এসব বিষয়ে একজন সর্বন্ধর আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×