ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর এম শামসুর রহমান

শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির অনন্য এক প্রতিভা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির অনন্য এক প্রতিভা

উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী নওগাঁ কে ডি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে (স্থাপিত ১৮৮৪ খ্রিঃ) প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একটানা দশ বছর অধ্যয়ন করেছি। বাড়ি নওগাঁ শহরেই। শ্রী শশধর কুণ্ডু নামে এই বিদ্যালয়ে একজন প্রবীণ সহ-প্রধান শিক্ষক ছিলেন সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের প্রায় শেষ অবধি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অধিককাল আগের গণিতে এমএসসি। সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত কুণ্ডু স্যার আমাদের গণিত পড়াতেন। পড়াতেন খুবই যতœ সহকারে। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিল। পরীক্ষা হলে ছাত্রদের আসন বিন্যাস ও তাদের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকতেন তিনি। মাঝে মধ্যে তার শিক্ষকতা জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা আমাদের বলতেন। প্রয়াত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের একটি কথা আজও আমার মন আলোড়িত করে। শিক্ষক মহাশয় আমাদের কাছে কুড়ির দশকের প্রথম ভাগের একটি অভিজ্ঞতার আলোকপাত করছেন। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির নিশ্চিতকরণে পরীক্ষা হলে তিনি গেলেন যথারীতি পরীক্ষা শুরুর দেড়-দুই ঘণ্টার মাথায়। একদিন পরীক্ষা হলে দেখলেন সিটে তার প্রিয় ছাত্র ‘হুমায়ূন’ নেই। ‘কী ব্যাপার, হুমায়ূন আজ পরীক্ষা দিতে আসেনি?’ কু-ু স্যারের এই বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন ছিল হল পরিদর্শকের কাছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রত্যুত্তর, ‘স্যার এই তো কিছুক্ষণ হলো খাতা জমা দিয়ে হুমায়ূন চলে গেছে।’ শ্রী কু-ু এতে উৎকণ্ঠিত হলেন। হুমায়ূনের প্রায় সব পরীক্ষায় নির্ধারিত সময়ের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়ার কিছু পরে খাতা জমা দিয়েই হল থেকে প্রস্থানের খবরের প্রতি স্যারের বিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। কে সেই হুমায়ূন, তিন ঘণ্টার পরীক্ষা মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টায় শেষ করে পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে যেতেন? সর্বোচ্চ ও ভাল নম্বরও পেতেন। একজন নবীন শিক্ষার্থীর পক্ষে এত অল্প সময়ে পূর্ণ নম্বরের উত্তর দেয়া এক বিরল দৃষ্টান্তই বলা যেতে পারে। কালক্রমে কু-ু স্যারের ‘হুমায়ূন’ হলেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী স্বনামখ্যাত হুমায়ূন কবির। ১৯২২-এ নওগাঁ কে ডি স্কুল থেকে খুবই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে তিনি ইংরেজীতে লেটার পেয়ে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নওগাঁয় পিতা কবির উদ্দিন আহমদের সরকারী চাকরি সূত্রে হুমায়ূন কবির তখন ওই স্কুলে উচ্চতর শ্রেণী থেকে পড়াশোনা করতেন। হুমায়ূন কবিরের প্রকৃত নাম হুমায়ূন জহির উদ্দিন আমির-ই-কবির। তার আদি নিবাস ফরিদপুর। জন্ম ১৯০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে। মৃত্যু ১৯৬৯-এর ১৮ আগস্ট কলকাতায়। আজ প্রফেসর কবিরের ১১১তম জন্মবার্ষিকী। স্কুল পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। এই কলেজ থেকে ইংরেজীতে লেটার মার্কসহ আইএ পরীক্ষায় হুমায়ূন কবির তৃতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। সেই সময়ের অত্যন্ত মেধাবী সহপাঠিনী শান্তি দেবীর সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯২৮ সালে বৃত্তি নিয়ে হুমায়ূন কবির বিলেত যান এবং অক্সফোর্ডের ঊীবঃবৎ কলেজে ভর্তি হন। গড়ফবৎহ এৎবধঃং তথা দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে অনার্স পড়াশোনা করেন। ১৯৩১-এ অনার্স পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেন। অক্সফোর্ডে ছাত্রাবস্থায় ইউনিয়নের সম্পাদক ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও হুমায়ূন কবির ছিলেন পারঙ্গম। তিনি অক্সফোর্ডে আইনস্টাইন ও রাসেলের ওপর হারবার্ট স্পেন্সর বক্তৃতামালায় অংশ নেন। তিনিই প্রথম এশীয় যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন। ভারতের অন্ধ্র ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন এবং ইংরেজী সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। প্রফেসর কবির কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের একান্ত সচিব ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি এবং ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহরু হুমায়ূন কবিরকে ঝঃধঃব গরহরংঃবৎ ভড়ৎ ঈরারষ আরধঃরড়হ হিসেবে নিয়োগদান করেন। ১৯৫৮ সালে মৌলানা আজাদের মৃত্যুর পর প্রফেসর কবিরকে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান গবেষণা ও সংস্কৃতি এবং পেট্রোলিয়াম ও কেমিক্যালসমন্ত্রী। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে একত্রে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ গঠন করেন এবং পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ (১৯৩৭-৪৭) কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে তার ভাষণ ছিল প্রণিধানযোগ্য। চিন্তাশীল লেখক, শিক্ষাবিদ এবং কবি হিসেবেও তিনি প্রসিদ্ধিলাভ করেন। বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় দর্শন, সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞানের নানাবিধ বিষয়ে লেখালেখিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৯২০ সালে তিনি স্কুল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকালেও তার ওপর ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্বভার অর্পিত হয়। বিলেত থেকে ১৯৩২-এ দেশে ফিরে এসে হুমায়ূন কবির ‘বারোমাসী’ নামক পত্রিকার সম্পাদক হন। বাংলা সাময়িকীর প্রকাশনায় উচ্চমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘চতুরঙ্গ’ সম্পাদনায় (১৯৩৯-৬৯) গুরুদায়িত্বও পালন করেন তিনি। স্বপ্নসাধ (১৯২৭), সাথী (১৯৩০), অষ্টাদশী (১৯৩৮) তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব (১৯৪২), বাংলার কাব্য (১৯৪৫), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪৫), মার্কসবাদী (১৯৫১), নয়া ভারতের শিক্ষা (১৯৫৫), শিক্ষক ও শিক্ষার্থী (১৯৫৭) তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আলীগড়, অন্নমালাই, বিশ্বভারতী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কারের গৌরব অর্জন করেন। প্রফেসস হুমায়ূন কবিরের পৈত্রিক বাড়ি ‘কবিরবাগ’ ফরিদপুরের আলিপুরে। সবুজ বৃক্ষরাজি বেষ্টিত মনোরম পরিবেশের এ ভিটেমাটি দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়ে। সেখানে শ্বেতপাথরে খোদিত প্রফেসর কবিরের সনেট স্মরণ করিয়ে দেয় এই উপমহাদেশের অনন্যসাধারণ এক প্রতিভার কথা। স্বাধীনতা উত্তরকালে কবিরবাগের অনেকটা অংশজুড়ে স্থাপিত হয়েছে হুমায়ুন কবিরের মাতা-পিতার নামে ‘সাজেদা-কবিরউদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।’ প্রথম দিকের কথায় এখন ফিরে এসে বলি, আজ কু-ু স্যার নেই। শ্রদ্ধাষ্পদ হুমায়ূন কবির নেই। কিন্তু পরম করুণাময়ের অসীম করুণায় আমরা আছি। কে ডি স্কুল আছে। তাই তো প্রফেসর কবির তথা স্কুলের প্রায় শতবর্ষ পূর্বের একজন প্রাক্তন ছাত্রকে তার ১১১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরেক প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি। নিবেদন করছি তার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। লেখক : ফেলো, ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন ও সাবেক ডিন, গণিত ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×