ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাসিনা-আব্বাস বৈঠক ॥ পশ্চিম তীরে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপনের নিন্দায় বাংলাদেশ

ফিলিস্তিনের স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় সমর্থন অব্যাহত

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফিলিস্তিনের স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় সমর্থন অব্যাহত

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানে ‘দুই জাতি দুই রাষ্ট্র’ নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নতুন করে বসতি স্থাপনের উদ্যোগের নিন্দা জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব আলোচনা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে একটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ কমিশন গঠনে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসের এক বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ফিলিস্তিনীদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় সমর্থন করে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নতুন করে বসতি স্থাপনের উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ইসরাইল ও ফিলিস্তিন ইস্যু সমাধানে ‘দুই জাতি দুই রাষ্ট্র’ নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। মাহমুদ আব্বাসকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনীদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় সমর্থন করে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ফিলিস্তিন দেশটি এখন বিশেষ ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। বিশেষ করে ইসরাইলের আগ্রাসনবাদী পদক্ষেপের ফলে টু স্টেট সলিউশনের কথা আমরা অনেক দিন ধরে শুনে আসছিলাম, তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য বাংলাদেশের যে ‘চিরন্তন’ সমর্থন আছে, তাও অব্যাহত থাকবে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। নতুন করে সেটেলমেন্ট হওয়ার যে উদ্যোগ ইসরাইল নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তার নিন্দা করেছেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইয়াসির আরাফাতের যে সমর্থন, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াসির আরাফাতের যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, সে বিষয়টিও তিনি বৈঠকে তুলে ধরেছেন। ইসরাইলকে এখনও স্বীকৃতি না দেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন বলে শহীদুল হক জানান। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিলিস্তিন কিন্তু ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করেছে। বাংলাদেশ স্বীকৃতি দান করেনি। বাংলাদেশ তখনই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে, যখন দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ফিলিস্তিনী শিক্ষার্থীদের বহুদিন ধরে বাংলাদেশে বৃত্তি দেয়ায় বৈঠকে মাহমুদ আব্বাস কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্র সচিব জানান, দুই নেতার মধ্যে একান্ত ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ কমিশন কমিটি বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মাধ্যমে দু’পক্ষের পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। প্রেস ব্রিফিংয়ে সূচনা বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে মাহমুদ আব্বাসকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনা। এ সময় সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর দুই নেতার একান্ত বৈঠক শুরু হয়। তারপর বিকাল চারটায় শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, উপদেষ্টা গওহর রিজভী, বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের একটি যৌথ কমিটি গঠনে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। শেখ হাসিনা ও মাহমুদ আব্বাসের উপস্থিতিতে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এতে সই করেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার দেন সেনাবাহিনীর নয় পদাতিক ডিভিশন। পরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তিনি। নীরবতা পালন শেষে তিনি সেখানে রাখা পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। এছাড়া স্মৃতিসৌধে একটি বকুল ফুলের গাছের চারা রোপণ করেন। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হকসহ ও সাভারের স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুর রহমান। সাভার থেকে বেলা ২টা ৫০ মিনিটে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পৌঁছান ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট। সেখানে তাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। তিনি ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্টকে জাদুঘরের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখান। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মাহমুদ আব্বাস। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এমন একটা সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইসরাইলকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনও অবশ্য বরাবরের মতো ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছিল। এর আগের ওবামা সরকার শেষ সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দেয়নি। তবে ইসরাইলের তেল আবিবে থাকা মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে জেরুজালেমে নেয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অঙ্গীকারের বিষয়ে আলোচনা মাত্র শুরু হয়েছে। সে কারণে এই সফরকে ফিলিস্তিনের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সরকার সবসময়ই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও তার জনগণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এসেছে। ইসরাইলের আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের পক্ষেও কথা বলে আসছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি দিন দিন বিশ্বের সমর্থন বাড়ায় সে দেশের মানুষের জীবনেও পরিবর্তন আসছে। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পতাকা তোলা হয়। তবে ঢাকা সফরের সময় ফিলিস্তিনের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন মাহমুদ আব্বাস। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে মত বিনিময় করেন। এরপর মাহমুদ আব্বাস তাঁর সম্মানে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ কর্তৃক আয়োজিত একটি নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা ছাড়ার আগে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করবেন মাহমুদ আব্বাস। তিন দিনের সরকারী সফর শেষে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট আজ শুক্রবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা ত্যাগ করবেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বুধবার বিকেলে ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্ট মোঃ আব্দুল হামিদের আমন্ত্রণে ঢাকা সফরে এসেছেন তিনি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. রিয়াদ আল মালকী, প্রধান বিচারপতি মাহমুদ আলহাব্বাশ, রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র নাবিল আবুরুদাইনাহ, কূটনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মাজদি খালদিসহ উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা ঢাকায় এসেছেন।
×