ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাচার হওয়াদের ৬০ ভাগই কিশোরী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

পাচার হওয়াদের ৬০ ভাগই কিশোরী

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ তাসমিনা আক্তার। বয়স ১৬। বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর। বাবা কৃষক আর মা গৃহিণী। সম্প্রতি তার প্রতিবেশীর এক আত্মীয় তাকে বেড়াতে নেয়ার নাম করে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখানে তার জায়গা হয় পতিতালয়ে। শেফালীর মতো অনেক শিশু ও নারী এভাবেই প্রতিনিয়ত বিদেশে পাচার হচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্রের তৎপরতায়। বাধ্য হচ্ছে যৌনকর্মী হতে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৪শ’ নারী ও শিশু পাকিস্তান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারী হিসাব অনুযায়ী, যারা পাচারের শিকার হচ্ছে তাদের ৬০ ভাগেরও বেশি কিশোরী। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। তবে সেন্টার ফর উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে ১০০ শিশু এবং ৫০ জনের বেশি নারী বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৫৮ জন পাচার, ১২৮জন নিখোঁজ, ১৪১জন অপহরণ এবং ২২২জন নারীকে উদ্ধারের তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে ২৫ জন নারী ও শিশুর পাচার হওয়ার তথ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বিগত বছরে ২৭০ জন অপহরণ, ৭৮জন নিখোঁজ এবং ৭৬০ জন নারী ও শিশুর উদ্ধারের তথ্য পুঞ্জীভূত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের সংকলিত তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ৮০৩টি মামলা দায়ের হয়েছে, যেখানে ৪৭৭ জন নারী ও শিশু পাচারের শিকার। কিন্তু এই ১১ মাসে মাত্র ৪জন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাবস্ত হয়েছে। মামলার গতি তদন্ত থেকে বিচারিক প্রক্রিয়া পর্যন্ত অত্যন্ত শ্লথ হওয়ায় এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি না করতে পারায় অপরাধের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলছে। তবে সংখ্যায় ভিন্নতা থাকলেও প্রতিবছর যে নারী ও শিশু পাচার বাড়ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী এ্যাডভোকেট সালমা আলী। তিনি বলেন, ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ রাষ্ট্রপতির সম্মতি পায়। এই আইনে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু চার বছর পার হলেও আইনের বিধিমালা হয়নি। বলা হয়েছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা হবে, কিন্তু হয়নি। অথচ পাচার বন্ধে তা করা জরুরী। এছাড়া ভুক্তভোগীদের আইনী সহায়তা পেতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এ্যাডভোকেট সালমা আলী। তিনি বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার স্থাপনসহ সরকারের বেশ কিছু ভাল পদক্ষেপ থাকলেও পুলিশের হয়রানি বন্ধ হওয়া জরুরী। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীরা যাচ্ছেন চাকরির আশায়। কিন্তু তারা প্রায়শ প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হন। হাত-পা কাটা, আগুনে ছ্যাঁকা ছাড়াও বিকৃত যৌন লালসার শিকার হয় গৃহবধূকে ভাল চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে লেবাননে নেয়া হয়। লেবাননের এয়ারপোর্ট থেকেই ওই গৃহবধূকে উক্ত দেশের পতিতালয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে দেয়া হয়। এরকম অনেক ঘটনা আমরা বিগত বছরগুলোতে হরহামেশাই পত্রিকার পাতায় পড়ছি, আর অনুশোচনায় ভুগছি। নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হচ্ছে নির্যাতনকারীর শাস্তি না হওয়া। যেখানে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হওয়ার কথা, সেখানে দেখা যায় ৫-১০ বছর লেগে যাচ্ছে। বিচার দ্রুত হলে এবং মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হলে নারী নির্যাতনের হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তাই মামলা অনুপাতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ও বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। তিনি আরও বলেন, ‘মানব পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়। এ ট্রাইব্যুনালের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অতিশীঘ্র পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর অধীনে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। সেইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ও শিশু নির্যাতন রোধে বিদ্যমান অন্যান্য আইনের অধীন দায়েরকৃত মামলাসমূহ নিয়মিত মনিটরিং এর আওতায় আনা যেন আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলাসমূহ নিষ্পত্তি এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে ক্রমশ হ্রাস পাবে নারী ও শিশু পাচারসহ নারীর প্রতি সহিংসতা।’
×