ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের উন্মত্ততা

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

তারুণ্যের উন্মত্ততা

ফুটফুটে একটি কিশোরের নাম আদনান কবির। উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র। ৬ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে এ্যাডিডাসের কালো ব্যাগ কাঁধে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় সে। মাগরিবের আজানের পর পরিবার জানতে পারে মর্মান্তিক এক সংবাদ- খুন হয়েছে আদনান। জোর পুলিশী তৎপরতায় খুনীরাও ধরা পড়েছে অচিরেই। তারা অপরিচিত কেউ নয়, আদনানেরই সতীর্থ, বন্ধুবান্ধব, তবে প্রতিপক্ষ। সর্বশেষ আদনান হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত নয়জন আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে দু’জন। তথাকথিত ‘গ্যাং কালচারের’ ভয়াবহ বলি আদনান। নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজের অন্তর্কলহের নির্মম শিকার মাত্র ১৫ বছর বয়সী এই কিশোর। আরও যা ট্র্যাজেডি তা হলো, আদনান নাইন স্টার গ্রুপের সদস্যভুক্ত হলেও আগে সে মেলামেশা করত ডিসকো বয়েজের সঙ্গে। ঘটনা যদি এখানেই থেমে থাকত, তাহলেও কথা ছিল। আদনান হত্যাকা-ের পর পরই এক কিশোর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই তোর খুনীকে বাইর কইরা জবাই দিমু।’ উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত অভিভাবকদের মধ্যে এই প্রশ্ন স্বভাবতই জেগে ওঠা স্বাভাবিক যে, এসব কী হচ্ছে দেশে? একেবারে কিশোর বয়সী বাচ্চা ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে পড়ছে নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকা-ে! প্রায় সবাই সমবয়সী, সহপাঠী, একই স্কুল অথবা পাশাপাশি স্কুলেই পড়াশোনা করে সবাই। সর্বোপরি নিকট প্রতিবেশী। চাই কী, ঈদ কিংবা অন্য কোন পালাপার্বণে একজন আরেকজনের বাসায়ও গিয়েছে, দাওয়াতও খেয়েছে। মিলিত হয়েছে কোন উৎসব আয়োজনে। সেই বন্ধুই কিনা হঠাৎ করে একদিন ভয়ঙ্কর শত্রু হয়ে যায়, একেবারে খুন করে ফেলে! কিশোর তরুণদের এভাবে বখে যাওয়া, দলাদলি, গ্রুপিং-লবিং, পাড়া-মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদিকে বলা হয় ‘গ্যাং কালচার।’ আইনের পরিভাষায় জুভেনাইল সাবকালচার। এ নাকি নগরায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে একে কালচার বলতে দ্বিধা জাগে। বরং বলা যেতে পারে অপসংস্কৃতিÑ যা সর্বোতভাবে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য। উত্তরা পুলিশের নথিপত্র বলছে, এই দুই গ্রুপের মধ্যে গত আট মাসে সংঘাত-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে পাঁচটি, তিনটি মারামারি, চতুর্থটি ছুরিকাঘাত এবং পঞ্চমটি খুনের। প্রশ্ন জাগে, এটাই কি শেষ? এও সত্য যে, উত্তরার মতো ভয়ঙ্কর সব গ্রুপ গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে রাজধানীর অন্যত্র, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও অন্যত্র। এরা প্রায়ই তুমুল হর্ন বাজিয়ে তীব্র গতিতে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় হোন্ডায়, সমবয়সী মেয়েদের সকাল-বিকেল উত্ত্যক্ত করে, ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়, মোবাইলে অশ্লীল ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে, খেলার মাঠে হামলা চালায় প্রতিপক্ষের ওপর, সর্বোপরি ছিনতাই-চাঁদাবাজি তো আছেই। বেপরোয়া এসব তরুণ কিসের উন্মাদনা, বঞ্চনা অথবা বীরত্ব দেখাতে এসব করে বেড়ায় সমাজে? প্রসঙ্গত পাঠকের মনে পড়তে পারে ঐশীর কথা, যে তার পুলিশ অফিসার বাবা ও মাকে কফির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলেছিল প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে অথবা চট্টগ্রামের ঘটনাই বা কম কী? যেখানে সহপাঠী বন্ধুরা ছাদে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছিল হিমাদ্রীকে। কিশোরদের এসব অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য শুধু মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে দোষ দেয়া যাবে না। শুধু থানা- পুলিশ দিয়েও হবে না। এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুদায়িত্ব রয়েছে সমাজ, পরিবার ও অভিভাবকদের, বিশেষ করে মা-বাবা, ভাই-বোনের। খেলাধুলা কিংবা পার্টির ছলে ছেলেটি কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেশে, তা নিয়মিত রাখতে হবে নজরদারিতে। পাড়া-মহল্লার মুরব্বিরাও এক্ষেত্রে দেখভাল করতে পারেন। যথাযথ ভালবাসা দিয়ে সন্তানদের বোঝালে বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা পেতেও পারে তারা।
×