ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার স্বরূপ ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও নয়া  বিশ্ব ব্যবস্থার স্বরূপ ॥ অভিমত

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যদি পরিবর্তন আসে, তাতে করে তা ইউরোপের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। ফলে ট্রাম্পের উত্থান এবং তার ঘোষিত নীতি যদি তিনি কার্যকর করার উদ্যোগ নেন, তা বিশ্বে এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি যেসব প্রস্তাব করেছেন বা দিয়েছেন, তা যদি তিনি কার্যকর করেন, তাহলে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় সেখানে এক ধরনের শ্বেতাঙ্গ উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। এখন তার ঢেউ এসে লেগেছে ইউরোপে। সম্প্রতি ইতালি ও অস্ট্রিয়ায় দুটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ওই নির্বাচন একটি ‘মেসেজ’ দিয়ে গেছে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ঐক্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ওই দুটি নির্বাচনের ফল একটি সতর্কবার্তা। পার্লামেন্টের ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন ও সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে এ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই গণভোটে ‘না’ এর জয়কে দেখা হচ্ছে অভিবাসন ও ইইউবিরোধী শক্তির বিজয় হিসেবে। গণভোটে ‘না’ জয়যুক্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি পদত্যাগ করেছেন। এতে বিজয়ী হয়েছেন ফাইভ স্টার মুভমেন্ট পার্টির নেতা বেবে গ্রিলো। বেবে অতি সম্প্রতি রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বাতিলের প্রশ্নে গণভোট দাবি করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি এ গণভোটের আয়োজন করবেন। একই সঙ্গে অভিবাসনবিরোধী নর্দার্ন লীগের নেতা মাত্তিও সালভিনিও গণভোটের ফলাফলে খুশি। এর মধ্য দিয়ে ইউরো জোনের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইতালিতে যে প্রচ- একটি অভিবাসন তথা ইউরোপিয়ান ঐক্যবিরোধী শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণিত হলো। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসনবিরোধী ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী নর্বাট হফার পরাজিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তিনি প্রায় বিজয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। নব্য নাজি নেতা হফার ইইউ থেকে অস্ট্রিয়াকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচ- অভিবাসনবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী। অস্ট্রিয়ায় তার যে জনপ্রিয়তা রয়েছে, নির্বাচনে বিপুল ভোটপ্রাপ্তি এর বড় প্রমাণ। তিনি হেরে গেলে ইউরোপিয়ান নেতারা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন বটে; কিন্তু ভয়ের কারণ হচ্ছে ২০১৭ সালে ফ্রান্স, হল্যান্ড ও জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ দেশগুলোতে অভিবাসনবিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত রয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অভিবাসন ও ইইউবিরোধী দলগুলো ভাল করেছে। ফলে তারা যে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ইউরোপের দক্ষিণপন্থী দলগুলোকে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছে। ট্রাম্পের অভিবাসন ও ইসলামবিরোধী অবস্থান এদের উৎসাহিত করেছে। ট্রাম্পের এ বিজয় প্রমাণ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে যে ‘লিবারেলিজম’ এর ধারণা বহমান ছিল তা এখন ভাঙছে। কট্টরপন্থী উগ্র এক ধরনের জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একথা ভারতের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য (বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাস), তেমনি প্রযোজ্য তুরস্কের ক্ষেত্রেও (এ কে কে পার্টির একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা)। ইউরোপে ব্যাপক সিরীয় শরণার্থীর আগমনের কারণে সেখানে সমাজে রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণের জন্ম হয়েছে। এতে করে দেখা যায়, জার্মানি ও ফ্রান্সে কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর উত্থান ঘটেছে। এরা মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। একটা কট্টর দক্ষিণপন্থী ইসলামবিরোধী ‘রাজনৈতিক স্রোত’ এখন সারা ইউরোপে বইছে। এর প্রভাব পড়ছে সেখানকার নির্বাচনে। ট্র্যাডিশনাল দলগুলো কট্টরপন্থীদের কাছে হেরে যাচ্ছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে সিরীয় শরণার্থীদের ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সে আশ্রয়দানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে অভিবাসনবিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে। এরা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভাল করছে। আমি অন্তত ৭টি দেশের নাম বলতে পারব, যেখানে দক্ষিণপন্থী নব্য নাজি পার্টি এ অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। যেমন বলা যেতে পারে, ফ্রিডম পার্টি (অস্ট্রিয়া), ল’ এ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (পোল্যান্ড), ফিদেস্জ (হাঙ্গেরি), সুইডেন ডেমোক্র্যাটস (সুইডেন), গোল্ডেন ডন (গ্রিস), ন্যাশনাল ফ্রন্ট (ফ্রান্স) এবং অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (জার্মানি) পার্টির কথা। ফ্রিডম পার্টির নেতার (নর্বাট হফার) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। সংসদে এদের আসন সংখ্যা এখন ৪০ (মোট আসন ১৮৩)। পোল্যান্ডের নির্বাচনে ল’ এ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে এরা ভোট পেয়েছিল শতকরা ৩৯ ভাগ। হাঙ্গেরিতে ফিদেস্জ পার্টি সরকারের অংশীদার। গ্রিসে বামরা ক্ষমতায় থাকলেও কট্টর দক্ষিণপন্থী পার্টি ‘গোল্ডেন ডন’ এর সংসদে আসন রয়েছে ১৮টি। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পুরনো রাজনৈতিক সংগঠন। অভিবাসন ইস্যুতে তারা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে শতকরা ২৭ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে। আর জার্মানির মতো ইউরোপের বড় গণতান্ত্রিক দেশে দক্ষিণপন্থী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে ৪ দশমিক ৭ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (শতকরা ৫ ভাগ ভোট পেলে তারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত)। এসব দলের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল আছে। এরা সবাই অভিবাসনবিরোধী, ইসলামবিরোধী এবং ‘শ্বেতাঙ্গ’ সুপ্রিমেসিতে বিশ্বাসী। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী ওইসব নেতার রাজনৈতিক দর্শনের একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাম্প নিজে ইসলামবিরোধী। অভিবাসনবিরোধী এবং তার যে সেøাগান ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’-এর পেছনে কাজ করেছে শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির বিষয়টি। বিশ্বজুড়েই এক ধরনের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। আফ্রিকার অনেক দেশের কথা বাদই দিলাম। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারত ও তুরস্কের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। মোদি ‘হিন্দুত্ববাদের’ সেøাগান তুলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। আর অতি সম্প্রতি তুরস্কে এরদোগান তথাকথিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে গুলেনপন্থীদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনে পুরো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের নামে সেখানে কায়েম হয়েছে একনায়কতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বরাবরই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের বিজয় এখন অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সেখানে ‘হেইট ক্রাইম’ বেড়েছে। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। এ সমাজকে মানুষ আগে কোনদিন দেখেনি। তাই আগামী ৪ বছর ওই দেশে কী হবে, এ নিয়ে চিন্তা অনেকের। পিউ রিসার্চ একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তাতে বেরিয়ে এসেছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ মনে করে ট্রাম্পের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তেমন শ্রদ্ধাবোধ নেই। গত ২৭ অক্টোবর (২০১৬), অর্থাৎ নির্বাচনের আগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যদি পরিবর্তন আসে, তাতে করে তা ইউরোপের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। ফলে ট্রাম্পের উত্থান এবং তার ঘোষিত নীতি যদি তিনি কার্যকর করার উদ্যোগ নেন, তা বিশ্বে এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি যেসব প্রস্তাব করেছেন বা দিয়েছেন, তা যদি তিনি কার্যকর করেন, তাহলে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। এতে করে ইউরোপীয় রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। এরই মধ্যে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ সেখানে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ব্রিটেনের আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে রায় হয়েছে। তবে এখনও তা কার্যকরী হয়নি। ব্রিটেন ২ বছর সময় পাবে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার। ৫ ডিসেম্বর ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শুরু করতে পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন কিনা এ বিষয়ে একটি আপীলের শুনানি করেছে ব্রিটেনের সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টের ১১ জন বিচারক শুনানি শুনছেন এবং আগামী জানুয়ারি মাসে এ ব্যাপারে একটি রায় দেয়া হবে। যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে, জনমতে একটি রায় পাওয়ার পর পার্লামেন্টের আদৌ তা অনুমোদনের প্রয়োজন কিনা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে নির্বাহী ক্ষমতাবলে লিসবন চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করতে পারেন। এক্ষেত্রে হাউস অব কমন্সে সংসদ সদস্যদের অনুমোদন নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, লিসবন চুক্তির (যেখানে ইইউর সদস্যভুক্ত যে কোন দেশের বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে) অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করতে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে। এখন সুপ্রীমকোর্ট যে রায়ই দিন না কেন, ব্রিটেনের ইইউতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন নির্বাচনের আগে (২০১৫) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার দল বিজয়ী হলে ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে একটি গণভোট করবেন। সে গণভোটে তিনি হেরে যান এবং পদত্যাগ করেন। শুধু ব্রিটেন বলি কেন, পুরো ইউরোপে অভিবাসনবিরোধী জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ধর্মীয় উন্মাদনার ফোবিয়া। বিশেষ করে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে উগ্র গোষ্ঠী আইএসএ’র নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। এটাকে পুঁজি করেছে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয়ে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এখন আরও উৎসাহিত হয়েছে। ফলে আগামী এক দশকে নতুন এক ইউরোপের জন্ম হতে যাচ্ছে। ইইউ ভেঙে না গেলেও একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্ব ব্যবস্থায়ও প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেখানে ‘লিবারেলিজম’ এর কোন চিহ্ন থাকবে না। ফ্রান্স এর বড় প্রমাণ। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৭) প্রার্থী হবেন না। খুব দ্রুত পরিবর্তন আসছে বিশ্ব রাজনীতিতে। উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা আগামীতে বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করবে। ভয়টা সেখানেই। লেখক : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়.ঁশ
×