ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা উত্তর ওয়ার্ড-১

সুন্দর রাস্তাঘাটে চলাচলে স্বস্তি, কাঁচাবাজার না থাকায় দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

সুন্দর রাস্তাঘাটে চলাচলে স্বস্তি, কাঁচাবাজার না থাকায় দুর্ভোগ

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীর উত্তরা আবাসিক এলাকা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) এ আবাসিক এলাকাটির ১৪টি সেক্টর নিয়ে ১নং ওয়ার্ড গঠিত। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী এটি একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। তবে ঘোষণায় নয় রাস্তাঘাট আর পরিকল্পিত আবাসনের চিত্র দেখে অনেকটা বাস্তবেও তার দেখা মেলে। এক সময় ভাঙাচোরা প্রধান ও অলিগলির সড়ক, সিটি কর্পোরেশনের কোন আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার না থাকা, সড়কবাতি না জ্বলা, রাস্তার ধুলাবালি, নালা নর্দমা সংস্কার না করা, লেকের পানিতে সরাসরি পয়োবর্জ্য মিশে যাওয়া, বিনোদনের কোন প্রকার ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল এ এলাকার বাসিন্দাগণ। তবে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উত্তরার বর্তমান চেহারাকে পাল্টে দিতে ডিএনসিসি নির্বাচনের পর থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। জানা গেছে, এসব কাজ শেষ করা সম্ভব হলে হলে উত্তরা হবে প্রকৃত মডেল টাউন। সরেজমিনে দেখা গেছে, নানা উন্নয়ন কর্মকা-ের পরও আজ পর্যন্ত পরিকল্পিত এ এলাকাটিতে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সবসময়ই যানজট লেগে থাকা, কিছু স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করা, আবাসিক এলাকায় রাস্তার ওপর লেগুনা স্ট্যান্ড তৈরি করা, কিছু স্থানে ফুটপাথের উপরে দোকানের মালামাল রেখে দখল করা, ওয়াসার পাইপলাইন ফেটে পচা দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়া, শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ না থাকা, বিশাল এলাকায় কোন প্রকার কাঁচাবাজার না থাকা, সরকারী কোন উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা, প্রাথমিক শিক্ষায় কোন সরকারী ব্যবস্থা না থাকা, চাহিদার তুলনায় বৃহৎ কোন পার্ক না থাকা, মশার যথেষ্ট উপদ্রব এলাকাবাসীর যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার বিপরীতে নতুন কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণের পর প্রায় অনেক সমস্যারই সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন যার ফল এলাকার বাসিন্দাগণ সরাসরি ভোগ করছেন বলে দাবি ১নং ওয়ার্ডের কমিশনার আফসার উদ্দীন খানের। তার মতে, উত্তরার উন্নয়নে চলতি অর্থবছরে মোট ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের প্রায় ৪০ কিমি সড়ক, ৪৯ কিমি ফুটপাথ এবং ২০ কিমি ড্রেন নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। যার একাংশের কাজ বাকি রয়েছে। ১৯৭০ এর দশকে মডেল টাউন হিসেবে উত্তরাকে গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করে সরকার। ১০ লক্ষাধিক নাগরিকের সার্বিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য পরিকল্পনা করেই ১৪টি সেক্টর তৈরি করা হয়। উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বৃহত্তর উত্তরা এলাকার ভোটার সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজারের কিছু বেশি। তবে ১নং ওয়ার্ডটিতে ভাসমানসহ ৬ থেকে ৭ লাখ লোক বাস করেন। উত্তরাবাসীর প্রধান সমস্যা হচ্ছে কোন সেক্টর এমনকি বড় রাস্তার পাশেও সরকারী উদ্যোগে বিশাল এলাকাবাসীর জন্য কোন কাঁচাবাজার গড়ে তোলা হয়নি। যা এলাকাবাসীর বিশাল সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ লোকের জন্য কোন কাঁচাবাজার তৈরি না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী মডেল টাউন গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব নয়। বর্তমানে এটি এলাকাবাসীর প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কের সঙ্গে বিডিআর মার্কেটই উত্তরাবাসীর একমাত্র বাজার। এছাড়া আজমপুরে রেললাইনের জমিতে অবৈধভাবে কাঁচাবাজার গড়ে উঠলেও অবৈধ হওয়ায় কিছুদিন পরপর তা উচ্ছেদ করা হয়। যা নাগরিকদের জন্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া উত্তরা ৮নং সেক্টরের সরকারী স্টাফ কোয়ার্টারের কয়েকটি ফুটপাথ ছাড়া কোন বস্তি নেই বলে জানা গেছে, যা রাজধানীর অন্য যে কোন এলাকার চেয়ে ব্যতিক্রম। উত্তরা ৫নং সেক্টরের ৯/এ নং রোডের ৬নং বাড়ির বাসিন্দা মানিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ডিএনসিসি নির্বাচনের আগে উত্তরার ১৪টি সেক্টরের মধ্যে প্রতিটি অলিগলির রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা ও খানাখন্দ ছিল। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে কষ্ট হতো। রাস্তায় নামলেই ঝাঁকুনি খেতে হতো। বর্তমানে এ অবস্থা থেকে মানুষের মুক্তি মিলেছে। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে উত্তরা এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নে মোট ৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে রাস্তার উন্নয়নের এজন্য ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কয়েকশ গাছ কাটতে হয়েছে। পরে সুন্দর রাস্তা তৈরি করার কারণে এলাকাবাসীর ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির ১নং ওয়ার্ডের কমিশনার আফসার উদ্দীন খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা উত্তরাকে মডেল টাউন শুধু নামেই নয় কাজের মাধ্যমে রাজধানীর প্রকৃত মডেল টাউন হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ কাজ করছি। এজন্য ডিএনসিসির মধ্যে উত্তরাবাসীর সুবিধার্থে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। এমন কোন গলি নেই যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েনি। আমাদের প্রস্তাব ও নাগরিকদের চাহিদা অনুযায়ী ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হকের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী কিছুদিন পর উত্তরাতে নতুন করে উন্নয়ন কর্মকা- করার মতো তেমন কিছুই থাকে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিততি রাজধানীর যে কোন স্থানের চেয়ে ভাল। যার ফলাফল নাগরিকগণ সরাসরি ভোগ করছেন। এছাড়া নাগরিকদের চলাচলের সুবিধার্থে ১৫ কিমি ফুটপাথ নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রীন সিটি হিসেবে ঢাকাকে গড়তে সমগ্র উত্তরা এলাকাকে সবুজায়নের অংশ হিসেবে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ রাস্তার ধারে ও ফাঁকা স্থানে প্রায় ৩২ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। রাস্তার ধারে বা আর কোন ফাঁকা স্থান নেই যেখানে গাছ লাগানো হয়নি। এসব গাছ বড় হলে পুরো উত্তরা এলাকার চেহারাই পাল্টে যাবে। পুরো উত্তরা সবুজ টাউন হিসেবে পরিচিতি পাবে। উত্তরার ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য রাজউক কোন স্থান না রাখলেও সিটি কর্পোরেশন ১৪টি সেক্টরের ময়লা আবর্জনা রাখতে ১০নং, ১২নং সেক্টর ও আজমপুরের ৩টি সেকেন্ডারি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ময়লা ফেলা ও বর্জ্য সংগ্রহ করে রাখার জন্য স্থায়ী স্থাপনা নির্মিত হলো। এলাকার উন্নয়নে দিনরাত কাজ করছি। রাস্তাঘাটের উন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টরের মোট ৫২টি সড়ক সংস্কার কাজ করা হয়েছে। আরও ৬০টি রাস্তার কাজ চলমান রয়েছে। এর বাইরে ২০১৭ সালের আরও মোট ১০০টি রাস্তার কাজ সম্পন্ন করা হবে। এছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২৭ কিমি পানি নিষ্কাশন ড্রেন সংস্কার করা হয়েছে। প্রায় ২৩ কিমির মূল ও গলির ভেতরের সড়ক সংস্কার তথা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো আগামী কয়েক বছরেও সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরও কাজ চলমান রয়েছে। আফছার উদ্দিন বলেন, উত্তরার সড়ক, ফুটপাথ ও ড্রেন উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। আমরা সড়কে অবৈধ পার্কিং ও দোকান নিয়মিত উচ্ছেদ করছি। তবে যানজট নিরসনকল্পে কয়েকটি সড়ককে একমুখী করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া উত্তরার একমাত্র লেকটিতে বর্তমানে স্যুয়ারেজের পানি প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লেকটিতে বর্তমানে স্বচ্ছ পানি বহমান রয়েছে। আমি জনগণের অভিযোগ ও কষ্টের কথা শুনতে নিয়মিত অফিসে বসে সমস্যার সমাধানে কাজ করছি। নাগরিকদের প্রয়োজনে ওয়ারিশ সনদ, নাগরিকদের সন্তানদের জন্য জন্মসনদ, নাগরিক সনদ অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রদান করা হয়। উত্তরা এলাকার রাস্তার বাতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা উত্তরার সমস্ত সেক্টরের রাস্তায় ২০১৭ সালের প্রথম থেকে আধুনিক এলইডি বাতি লাগানোর কাজ শুরু করব। এর ফলে রাতের বেলায় রাস্তায় চলাচলে নাগরিকগণের সুবিধা হবে। আমরা উত্তরাকে পরিপূর্ণ আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়তে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করছি। তবে এজন্য সবার আগে জনসচেনতা প্রয়োজন। এজন্য তিনি সকলের সহযোগিতা চান। সরেজমিনে দেখা গেছে, এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ নেই। স্কুল কলেজের ক্লাস শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার সময় এসব স্কুল কলেজের প্রতিটির সামনে ও এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকা পর্যন্ত পুরো সেক্টরে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের আনা নেয়ার কাজে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি করে গাড়ি ব্যবহারকেই নাগরিকেরা দায়ী করেছেন। এসব গাড়ি সড়কের ওপরেই পার্কিং করা হয় বলেই রাস্তায় ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়। এমনও দেখা গেছে, মাত্র ৫ মিনিটে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা গাড়ি দিয়ে ১ ঘণ্টায় পার হতে হয়। ৭নং সেক্টরের আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে লেগুনা স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে দিয়াবাড়ী খালপাড় পর্যন্ত যায় এসব লেগুনাগুলো। তাই এ এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া ৪নং সেক্টরে চেইন শপ আগুড়ার সামনে তাদের কোন নিজস্ব পার্কিং না থাকায় রাস্তার উপরেই গাড়ি রেখে ক্রেতারা তাদের কাজ করছেন। এপিবিএনের কার্যালয়ে দক্ষিণ পার্শে¦র সিএনজি পাম্পের কারণে মূল সড়কেও যানজট লেগে থাকতে দেখা গেছে। রাতের বেলায় উক্ত এলাকার জসিমউদ্দীন মোড় থেকে কোন কোন সময় এয়ারপোর্ট পর্যন্ত জ্যাম লেগে থাকে। তবে উক্ত এলাকায় পানি ও বিদ্যুতের কোন সমস্যা না থাকলেও বর্তমানে গ্যাসের সঙ্কট প্রখর আকার ধারণ করেছে। সালমা নামের ৫নং সেক্টরের রোড নং ৯/এ এর বাসিন্দা এক গৃহিণী জানান, দিনের বেলায় গ্যাস নেই বললেই চলে। রাতে গ্যাস আসলেও তা অনেক সময় ১০টা বেজে যায়। ফলে খাবার খেতে খেতে রাত ১২টা বেজে যায়। এ বিষয়ে কেউ কোন কর্ণপাত করেন না। অফিসে অভিযোগ দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাস্তায় গাড়ি ঘোরানোর কারণে জসীমউদ্দীন মোড় এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চত্বরে যানজট লেগেই থাকে। উত্তরা সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকা হলেও উত্তরায় বর্তমানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ অফিস, দোকান ও ভাসমান কাঁচাবাজার। এলাকাবাসীর দাবি মূল ও গলির সড়কের উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদার করতে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, দ্রুত রাস্তায় এলইডি লাইট লাগানো, অবৈধ দোকানপাট নিয়মিত উচ্ছেদ করা, শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ তৈরি করা, প্রতিটি সেক্টরে খেলাধুলার ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যানজট কমাতে পুলিশের সঙ্গে ডিএনসিসির যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প গ্রহণ করার জোর দাবি জানান।
×