ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল আলম খান খসরু

অপারেশন রূপসী শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের টহলবোট ধ্বংস

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

অপারেশন রূপসী  শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের  টহলবোট ধ্বংস

(গতকালের পর) নৌকা ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই, আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম কী করতে হবে। আমি আবারও জিপটিকে এক নজর দেখেই আস্তে আস্তে হামাগুড়ির ভঙ্গিতে গড়িয়ে বিলের পানিতে পড়ি। শাড়ি দিয়ে নৌকাটি ঢাকা থাকার কারণে বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। আমি নৌকার নিচ দিয়ে ডুব সাঁতারে ব্রিজের তলায় এসে স্রোতের পানি লেগে ক্ষয় হওয়া শ্যাওলা পিচ্ছিল ইট হাত দিয়ে জাপটে ধরে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি ভীষণ ক্লান্ত আর আমার ভাবনায় তখন একটি বিষয়, এ অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে তো? পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে মারা যাব না তো? এমন বিক্ষিপ্ত সব ভাবনায় যখন খুব অস্থির ও অধীর বোধ করছি তখন হঠাৎ আমার চোখে পড়ল আমি যে ইট ধরে আছি তার ফাঁকে বেশকিছু ব্যাঙ। আর পানির ভেতর থেকে কিছু ছোট ও মাঝারি আকারের মাছ ছড় ছড় শব্দ করে লাফিয়ে চলে গেল। আমি টের পেলাম একটি ঢোঁড়া সাপ আমার শরীরের একেবারে পাশ ঘেঁষে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই যেন একটু শিউড়ে উঠলাম। ভাগ্য ভাল যে এ যাত্রায় সাপের কামড় থেকে বেঁচে গেলাম। নৌকা ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে এলে পাকিস্তানী সৈন্যরা জীপ থামিয়ে ওপর থেকে নৌকাকে থামতে নির্দেশ দেয়। ব্রিজের ওপর থেকেই সৈন্যদের মধ্যে একজন উর্দু ভাষায় চিৎকার দিয়ে বলে, ‘কিস্তি মে কই হায় (নৌকায় কেউ আছে)?’ আর মাঝিকে কাপড় সরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নৌকার ভেতরের অংশ দেখাতে বলে অর্থাৎ তারা নৌকায় কোন আরোহী আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এভাবে যাচাই করছিল। আমি ব্রিজের নিচ থেকে তাদের সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম। নৌকায় কোন আরোহী দেখতে না পেয়ে তারা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। এক মুহূর্তের জন্য আমি ভাবলাম যদি এলএমজিটি নৌকার উপরেই কোথাও থাকত, তাহলে তো আজই আমার এবং মাঝি সুনীলের জীবনের শেষ দিন হতো! আসলে তখন এ ধরনের ভয়ানক অশুভ আশঙ্কার কথা আমি এড়াতে পারছিলাম না। যাক, পর মুহূর্তে আমি আবার এক লম্বা ডুব সাঁতারে নৌকায় চড়ে বসি। ভেজা লুঙ্গিটা মাঝির সঙ্গে বদলে নেই। মাঝি তার গন্তব্যে রওনা হয়। এভাবে আমি পথের বাধা পেরিয়ে সকাল দশটা নাগাদ খান সাহেবের বাসায় এসে পৌঁছি। তার বাড়ির পাশে বিলে নৌকা বেঁধে রেখে মাঝিকে বলি সে যেন নৌকায় ঢোকা পানি ছেউতি দিয়ে সেঁচে রাখে। তারপর আমার অস্ত্র নৌকার পাটাতনের নিচে রেখেই মাঝিকে অপেক্ষা করতে বলে আমি বাড়ির আঙিনায় উঠে আসি। খান সাহেব আমাকে সানন্দে গ্রহণ করেন এবং প্রয়োজনে যুদ্ধ সময়ে তার বাড়িটিও আমাদের ব্যবহারের জন্য দিতে রাজি হন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে চান। তার সে ইচ্ছের কথা তিনি আমার কাছে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। খান সাহেব খুব সাহসী ছিলেন। তার স্ত্রী আমাকে দুধ চিতই পিঠা খেতে দেন। এ সময় বেশ ফর্সা ফুটফুটে ছোট একটি মেয়ে আমাদের পাশে এসে বসে। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করি। সে বলে রাজিয়া। আমি মনে মনে বলি তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই তো আজ আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ রাজিয়াকে বিয়ে করে আমার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা শিল্পপতি আহসান উল্লাহ মনি (রাজমনি ও রাজমনি-রাজিয়া সিনেমা হল এবং রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের মালিক)। যাক সে কথা, দুধ চিতই পিঠা খাওয়া শেষ করে আমি খান সাহেবের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম ঠিক সে মুহূর্তে আমরা বাইরে হৈ চৈয়ের শব্দ শুনতে পাই। আমি এবং খান সাহেব বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে সরু রাস্তায় এসে দাঁড়াই। তখন বেলা আনুমানিক বারোটা হবে হঠাৎ দেখি রূপসী বাজারের (শীতলক্ষ্যা নদীর পাশ থেকে) দিক থেকে লোকজন ‘আইল রে, আইল রে! পালাও পালাও’ বলে চিৎকার করে দিগি¦দিক ছুটছে। কেউ কেউ দৌড়ে আবার আমাদের দিকে আসতে থাকে, আমি তাদের মধ্যে একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? সে বলে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাজারে এসে জোর করে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। আর যাদেরকে পাচ্ছে তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাই প্রাণ ভয়ে লোকজন পালাচ্ছে। আমি আরও কয়েকজনকে ধরে জিজ্ঞেস করি সংখ্যায় তারা ক’জন? কেউ বলে পনেরো জন কেউ বলে বিশ জন। লোকজনকে প্রশ্ন করে আরও তথ্য জানতে পারলাম যে, পাক সেনারা তিনটি মোটরচালিত টহল বোটে বাজারে এসেছে, পাকিস্তানী সৈন্যদের সংখ্যা শুনে আমি উৎসাহিত হই। তারা আরও বেশ কয়েকবার ওই বাজার লুট করেছে কিন্তু কখনও বাজার ব্যতীত গ্রামের ভেতরে আসেনি। আমি তাদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেই। ভাবি, একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার এই তো সুবর্ণ সুযোগ! কীভাবে এ সুযোগ কাজে লাগাব তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ি। আমি খান সাহেবকে আমার সঙ্গে একটি সাহসী ছেলে দিতে বলি। তিনি আমাকে অজয় নামে স্থানীয় এক হিন্দু ছেলেকে দেন। আমি ওর হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম যুবকটি সাহসী। সে আমার উপযুক্ত সঙ্গী হতে পারবে। তাকে সঙ্গে নিয়ে এলএমজিসহ রওনা হলাম। যদিও নৌকায় চলাচল করার সময় আমি আমার এলএমজিটি নৌকার পাটাতনে অর্থাৎ নৌকায় বসার কাঠের নিম্নাংশে লুকিয়ে রাখতাম কিন্তু স্বভাবত অধিকাংশ সময় তা আমার হাতেই থাকত। ২৫ মার্চে ক্র্যাক ডাউনের পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ধীরে ধীরে সারাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং চলাচল পথ নিরাপদ রাখতে জায়গায় জায়গায় বাঙ্কার স্থাপন করে। পাকিস্তানী আর্মিরা শীতলক্ষ্যার ওপারে অর্থাৎ আমাদের অংশে এসে প্রথমেই নদীর কূল ঘেঁষে থাকা সকল গ্রাম ও বাড়িঘরের বাসিন্দাদের বিতাড়িত করে এবং বাজারসহ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে দেয়। যাতে আশপাশ থেকে কেউ এ্যাম্বুশ করতে না পারে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে রূপসীর একটি ছোট্ট বাজার রক্ষা পায়। এ বাজারটি অক্ষত থাকায় গ্রামবাসীর যেমন উপকার হতো তেমনই পাকিস্তানী সৈন্যরাও মাঝে মধ্যে ইঞ্জিন বোটে এসে এখান থেকে ডাল, আটা, লবণ, ম্যাচ, টর্চ লাইট ব্যাটারি ও শুকনা খাবার জোরপূর্বক নিয়ে যেত। তাই পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখলে ভয়ে লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যেত। আর নিমিষে বাজার খালি হয়ে যেত। যা হোক, অজয়কে নিয়ে আমি নৌকাযোগে বিলের পানি কেটে কয়েক মিনিটের মধ্যে রূপসী বাজারের অদূরে এসে থামি এবং দূর থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। দেখি তিনটি টহলবোট নদীর কিনারে পাশাপাশি বাঁধা আছে। এ টহল বোটগুলো দেখতে অনেকটা স্পিড বোটের মতোই তবে আকারে বড়, স্টিল বডি এবং ইঞ্জিনচালিত আর মাথার ওপর ছাউনি। এ ধরনের টহল বোটে দশ থেকে পনেরো জন আরোহী বসতে পারে। টহলবোটের সাইজ দেখে অনুমান করলাম একেক বোটে পাঁচ-ছয় জন করে সৈন্য এসেছে। এ সময় আমি একটু ভাবতে থাকি রেইড দিয়ে তাদের সঙ্গে লড়বো নাকি এ্যাম্বুশ করব। রেইড দিলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে অগ্রসর হতে হবে। আর এভাবে সবাইকে খতম করা যাবে না। এটা আমার জন্য ঝুঁকি মনে হলো। কারণ জীবিত সৈন্যরা গুলি ছুড়বে। আর এ্যাম্বুশ করলে তারা বেঘোরে মারা পড়বে, আবার ভাবলাম মাঝিকে পাঠিয়ে আমার পুরো টিম (সহযোদ্ধাদের) এনে তাদের রেইড দেই। কিন্তু সবাইকে আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এরই মধ্যে যদি সৈন্যরা চলে যায় তাহলে তো অপারেশনটা মিস হয়ে যাবে। তাই মুহূর্তেই আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম, কারণ তারা সংখ্যায় মাত্র গুটিকয়েক সৈন্য। আমি এ্যাম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বুঝতে পারলাম একসঙ্গে তিনটি টহলবোটই আমি ঘায়েল করতে পারব। আমার মনও সায় দিচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। তাছাড়া পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখলেই তাদের হত্যার জন্য আমার নেশা চেপে বসে এবং হাত নিসপিস করতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এর আগেও আমি ১৯৬৯ সালে ঢাকা নিউমার্কেটের ভেতর চার জন পাকিস্তানী সৈন্যকে ঘায়েল করি। সে কারণেই সামরিক ট্রাইব্যুনালে আমাদের (খসরু, মন্টু ও সেলিম) তিন জনের ১৪ বছরের জেল হয়। তাই তাদের যখন হাতের কাছে পেয়েছি তখন এ সুযোগ কোন মতেই হাতছাড়া করব না। বাঁচি আর মরি পাকিস্তানি সৈন্যদের আমি খতম করবোই। নিজের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করব। একজন পাকিস্তানী সৈন্যকেও জীবিত ছেড়ে দিব না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। পাটাতনের নিচ থেকে এলএমজি হাতে তুলে নিলাম। এলএমজিটি ‘ঝ’ (ঝধভবঃু)-তে লক করা ছিল। সেকেন্ডের মধ্যেই ‘ঝ’ থেকে লক খুলে সঙ্গে সঙ্গেই কক (কড়পশ) করে চেম্বারে গুলি নিয়ে এলাম এবং আবার ঝধভবঃু-তে দিয়ে রাখলাম। নদীর যেদিক দিয়ে বোটগুলো বাজারে এসেছে আমি মাথা নিচু করে এবং মাঙ্কি চাল দিয়ে ক্রলিং করে দৌড়ে এসে সেদিকের নদীর পাড়ে একটি ছোট পরিখা খনন করি। আমি জানি পাক সৈন্যরা টহল বোটে করে এ পথেই ডেমরা ঘাটে ফেরত যাবে। তাই নদীর পাড়ে এসে ঝোপঝাড়ের আড়ালে পজিশন নিতে প্রস্তুতি নেই। এখানে নদীর পাড় ঢালু এবং উঁচুনিচু। তাই ঝোপের আড়ালে মাটিতে বসার জন্য একটি পরিখা বা গর্তের প্রয়োজন। আমি অজয়কে একটি কোদাল আনতে বলি। সে কোদাল নিয়ে এসে খুব দ্রুত ভেজা মাটিতে বসার মতো কোন রকম একটি ছোট ট্রেঞ্চ (গর্ত বা পরিখা) খনন করে এবং আমি সুবিধা মতো পজিশন নিয়ে এলএমজির বাইপট (দুটি পায়া) খুলে খাড়া করে এলএমজির বাট ডান বোগলের উপরে ধরে ডান হাতের আঙ্গুল ট্রিগারের ওপরে রেখে বা হাত দিয়ে এলএমজিটি শক্ত হাতে ধরে ‘অ’ (অঁঃড়সধঃরপ)-তে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকি। আর অজয়কে মাথা নিচু করে নির্ভয়ে ঝোপের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে বলি। কাকতালীয় ব্যাপার হলো যে জায়গাটিতে আমরা বসে আছি তা অজয়ের বাড়ির অংশ। এ জায়গাটিতেই অজয়দের বাড়ি ছিল যা আগেই পাকিস্তানী সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছে। পোড়া দুটি বাঁশ তখনও ছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা রূপসী বাজার থেকে মালপত্র লুট করে তিনটি টহল বোটে করে ধীর গতিতে নদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণে অবস্থিত ডেমরা ঘাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বোটগুলো সারিবদ্ধভাবে (অর্থাৎ একটির পেছনে আরেকটি) ছিল। আমার অনুমান একেক বোটে পাঁচ-ছয়জন করে সৈন্য বসা ছিল। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারি হয়ে এলো। একটু পর টের পেলাম নিঃশ্বাস খুব ঘনঘন বের হচ্ছে। লুঙ্গি কাছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছি। ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে সেঁটে আছে। খালি পায়ে কাদার গর্তের মধ্যে আমি বসে আছি। আমার কোমরের বেল্টে গুলি ভরা চারটি ম্যাগজিন আর একটি গুলি ভরা ম্যাগজিন এলএমজিতে ফুল লোড করা সবমিলে পাঁচটি ম্যাগজিন। চিতা বাঘের মতো তীক্ষè দৃষ্টিতে আমি সবকিছু লক্ষ্য করছি আর এলএমজি তাক করে ঝোপের ভেতর চুপচাপ বসে আছি। এলএমজির মাথাটা একটুখানি বের হয়ে আছে। আমি তখন মনে মনে ভাবছি, এলএমজি চালানোর সর্বোচ্চ দক্ষতা আজ প্রদর্শন করব। এক ঐতিহাসিক বীরত্বের সাক্ষী করে রাখব শীতলক্ষ্যা নদীকে। এ দিনটি ইতিহাসে স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আর সৃষ্টিকর্তাও আমার সে ইচ্ছে পূরণ করেছে। সেদিন আমার এলএমজিতে যেন বিদ্যুত চমকে ছিল। সাধারণত যুদ্ধের সময় আমি বেশ স্বতঃস্ফূর্ত থাকি। পূর্ণ উদ্যোমে লড়াই করে বিজয়ের স্বাদ পাওয়ার আনন্দে আমার মন মেতে থাকে। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ইঞ্জিনচালিত টহল বোট তিনটি ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে তাদের গন্তব্যে। সেদিন পাকিস্তানী সৈন্যরা ছিল খুব নিরুদ্বেগ এবং গা-ছাড়া ভাব নিয়ে। তাদের হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল যে, এ্যাম্বুশের ফাঁদে পড়তে পারে এমন কোন ধারণা তাদের মনে ছিল না। অনেকটা নিশ্চিন্ত মনেই এগোচ্ছিল পাক সেনার দল! ঝোপের ফাঁক দিয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বোট তিনটিকে। সে দৃশ্য দেখার পর মুহূর্তেই যেন আমার ভেতর একধরনের তুমুল উত্তেজনা বিদ্যুত বেগে প্রবাহিত হলো। ততক্ষণে বোট তিনটি আমার রেঞ্জের মধ্যে এসে গেলে আমি শক্ত হাতে ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। সেসময় হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘জয় বাংলা’। আমি রুদ্ধশ্বাসে ট্রিগারে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক প্রকম্পিত করে প্রচ- শব্দে গর্জে উঠে আমার হাতের এলএমজি। আর আমার সমস্ত শরীরকে স্পন্দিত করে এলএমজি থেকে ছোড়া গুলি প্রথম গান বোটটিকে সবেগে বিদ্ধ করে। সেগুলোর গগনবিদারী তীব্র শব্দে নদীর পানিতেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রথম বোটটির ওপর গুলিবর্ষণ শেষ হওয়া মাত্র দ্বিতীয়টির ওপর গুলিবর্ষণ করি। তারপর তৃতীয়টির ওপর। প্রথম এবং দ্বিতীয় বোটটিকে আক্রান্ত হয়ে ডুবে যেতে দেখে তৃতীয় বোটটি ভাসতে ভাসতে মাঝ নদীতে চলে যায় এবং রক্ষা পায়। যদিও আমি তৃতীয় বোটটি থেকে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম, তবে সেটিতে থাকা পাকিস্তানী সৈন্যরা ঠিকই হতাহত হয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঁচার জন্য এদিক সেদিক লাফালাফি করে পজিশন নেয়ার চেষ্টা করার ফলে বোট দুটি কাত হয়ে ডুবে যায়। বোটে হতাহতের কারণে পাকিস্তানী সৈন্যদের সবার সলিল সমাধি ঘটে। হঠাৎ এমন আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা সেদিন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল একাধিক স্থান থেকে অনবরত তাদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হচ্ছে। তাই তারা আত্মরক্ষার জন্য ওপরের দিকে অনুমান নির্ভর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল। আহত ও অক্ষত সৈন্যরা জীবনের ভয়ে বোটের মধ্যে গড়াগড়ি শুরু করল। পাকিস্তানী সৈন্যদের ছোড়া কয়েকটি গুলি সাঁ-সাঁ করে আমার মাথার ওপর দিয়ে গাছের পাতা ভেদ করে চলে যায়। অথচ আমি শুধু একটি এলএমজি দিয়ে তাদের মোকাবেলা করেছি। সে এ্যাম্বুশের সময় আমার কাছে থাকা মোট পাঁচটি ম্যাগজিনের সবগুলোর গুলিই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে অপারেশনে একটি ম্যাগজিন শেষ হতে না হতে সঙ্গে সঙ্গেই কম সময়ের মধ্যে অপর ম্যাগজিন চেম্বারে লোড করেছি। আমার হাত অসাধারণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। আমার এলএমজির ব্যারেল প্রচ- তপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গোলাগুলি শেষে বিজয়ী বীরের বেশে আমি আবার অস্ত্র গুটিয়ে নিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরছিলাম তখন অসাবধানতাবশত হঠাৎ করে আমার হাত গিয়ে লাগে ব্যারেলে। ফলে আমার হাত পুড়ে সাদা ফোসকা পড়ে যায়। পরে আমি ব্যারেলটি পানিতে চেপে ধরে ঠা-া করি। একটি এলএমজি দিয়েও যে একজন যোদ্ধা অসাধারণ কর্তৃত্ব প্রদর্শন করতে পারে তার প্রমাণ হলো শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর প্রদর্শিত রূপসী বাজারের এ অপারেশন। আর তা সম্ভব হয়েছিল গেরিলা যুদ্ধবিদ্যার কৌশল আত্মস্থ থাকার কারণে। সেদিন আমি আমার অকুতোভয় সাহস, অসীম দূরদর্শিতা এবং অপূর্ব দক্ষতার মাধ্যমে অস্ত্র চালনার পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করি। যাকে বলে ‘হিট এ্যান্ড রান’। সত্যিই আমি সেদিন তার এক চমৎকার উদাহরণ প্রদর্শন করতে পেরেছিলাম। এদিকে অনেক সময় ধরে আমার এলএমজির ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনে রূপসী বাজার ও তার আশপাশের গ্রামের লোকজন ভয়ে এক কাপড়েই পালিয়ে নিরাপদ স্থানের খোঁজে চলে যায়। চলবে... লেখক : গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা
×