ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ

বিকল্প উৎসে লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় এবং ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় সাধারণ জনগণ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কমে যাওয়া এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন মন্দার কারণে মানুষ এখন সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রকে বেছে নিয়েছে। আর ব্যাংক হলো আমানতকারীদের বিনিয়োগের অন্যতম নিরাপদ স্থান। এ কারণে চাকরি শেষে অনেকেই জীবনের শেষে সঞ্চয়টুকু ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন। আর মাস শেষে মুনাফা দিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। তাই সবাই চায় যেখানে মুনাফা বেশি সেখানে তার বিনিয়োগটা করতে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে আমানত রেখে ঘাটতির মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। কাক্সিক্ষত লাভ না হয়ে বরং মুনাফা কমছে। কারণ ১০০ টাকা আমানত রেখে সর্বোচ্চ মুনাফা পাচ্ছেন এখন ৭ টাকায়। এ ৭ টাকার ওপর গ্রাহকের টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ এবং টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর কেটে নিচ্ছে সরকার। সব মিলে এখন ১০০ টাকা আমানত রেখে গ্রাহক সর্বোচ্চ নিট মুনাফা পাচ্ছেন ৫ টাকা। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে ১০০ টাকা আমানত রাখলে গ্রাহক নিট মুনাফা পাচ্ছেন ১০ টাকা। আবার মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে শুধু মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে একজন গ্রাহক ব্যাংকে ১০০ টাকা আমানত রাখলে বছর শষে প্রকৃতপক্ষে ১ টাকা কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ বছর শেষে তার ১০০ টাকা থেকে ১ টাকা কম আসছে। এ পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখতে দিন দিন নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। যার ফলে নাজুক অবস্থায় এসেছে ১৬ ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি । এর মধ্যে ১১ ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। বাকি পাঁচটির কোনটির ১ শতাংশ, কোনটির ৩ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। আরও ৯টি ব্যাংকের বিনিয়োগ নেতিবাচক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ৩০ জুন ভিত্তিক পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঋণ ও আমানতের প্রবৃদ্ধির এ ধারায় ব্যাংকিং খাতে সঙ্কট বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোন হরতাল, অবরোধের মতো কোন কর্মসূচী নেই। এর পরও বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো তহবিল পরিচালনব্যয় কমাতে আমানতের সুদ হারও অব্যাহত হারে কমিয়ে দিয়েছে। বলা চলে আমানতের হার কমাতে কমাতে এখন ব্যাংক রেট অর্থাৎ ৫ শতাংশের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। এরই প্রভাবে ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধিতে নাজুক অবস্থানে এসেছে। বিনিয়োগের এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করবে। কেননা, ব্যাংকগুলোর চলমান ব্যয় কমছে না। বরং বিনিয়োগ স্থবিরতায় আয় কমে যাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সরকারী ব্যাংক একটি, সাতটি বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক ও তিনটি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। ৩৩ শতাংশের নিচে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এমন পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে একটি সরকারী, তিনটি বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তার শাখাতে গত এক বছরে ২০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ কোটি টাকা এসেছে ব্যাংকের আমানত থেকে। অর্থাৎ ব্যাংকের আমানত ভেঙে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। তিনি বলেন, সরকারী ব্যাংকে লাভ আরও কম দেয়া হচ্ছে। সেভিং এ্যাকাউন্টধারীদের ১০০ টাকায় দেয়া হচ্ছে ৩ টাকা লাভ। আর ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ১০০ টাকায় লাভ দেয়া হচ্ছে ৫ টাকা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হলেও বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও ফিরে আসেনি। এসব কারণে ব্যাংক বেশি লাভ দিতে পারছে না। আর আমানতকারীরা লাভ কম দেখে চলে যাচ্ছেন সঞ্চয়পত্রে। আবার ব্যাংকে নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। যেটুকু বিনিয়োগ হচ্ছে তা চলমান বিনিয়োগ। অর্থাৎ চালু কলকারখানায় কাঁচামাল আমদানিসহ চলতি তহবিল সরবরাহ করা। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ আদায় আরও কমে যাচ্ছে। এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা স্বল্পমেয়াদী ঋণ নিয়েও তা পরিশোধ করতে পারছেন না। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা ঋণ খেলাপী হয়ে গেছেন। এদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের দুই মাসে এই খাতে নিট বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর আগস্ট মাসে নিট বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ২৯৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। একক মাস হিসেবে আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। যা গত অর্থবছরের তুলনায়ও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি আসে ২ হাজার ৬৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে এই খাতে নিট বিক্রি আসে ৩ হাজার ৪৯৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি আসে ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে অস্বাভাবিকহারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল র্কমকর্তা জানান, দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের কথা বিবেচনা করেই সরকার সঞ্চয়পত্রে ঋণের সুদ বাড়িয়েছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া মানে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া।
×