তরুণ ও প্রতিভাবান কবি শামীম হোসেন প্রথম দর্শনেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তার ব্যবহার, বাচনভঙ্গি এবং সপ্রতিভ আচরণ দিয়ে। এরপর কবিতা দিয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন হৃদয়ের গহীনে। তার কবিতা তার মতোই সহজ সরল এবং গতিময় যা সহজেই পাঠকের হৃদয়ে আসন গড়তে সক্ষম।
তিনি মূলত প্রেমের কবি। তা সত্ত্বেও শামীম হোসেনের কবিতায় যে নিসর্গচিত্র পরিস্ফুট হয় সেটা মনোমুগ্ধকর। আগ্রহ সৃষ্টি করে এমন কবি-তারুণ্য সময়ে না খুঁজলে সহজে আবিষ্কার করা যায় না। তিনি স্পষ্টতই প্রতিভাত হয়েছেন একজন মননশীল কবি-প্রতিভা হিসেবে। প্রতিভাবান মানুষ সচরাচর অনেক দেখা যায় কিন্তু এর মধ্যে কবিত্ব শক্তির অধিকারী মানুষ কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়। শামীম হোসেনকে আমার তেমনটি বলেই মনে হয়। তার লেখা আমাকে স্পর্শ করে।
শামীমের কবিতা আমার মনে বিদ্যুতের ঝলকানি এনে দেয়। কেননা, তার কবিতায় মা-মাটির গন্ধ আছে। একজন তরুণ কবির জন্য এটা কম কথা নয়। প্রকৃত কবিদের কাজ এ রকমই হয়। কখনও নেশা ধরিয়ে দেয়Ñ কখনও আশা জাগিয়ে তোলে আবার কখনও ভাষার বিবৃতিতে বিষণœ হয়। শামীম এক্ষেত্রে সফল তা বলাই চলে। কবিতায় তার চাষবাস যে নিরলস তা আমি দীর্ঘদিন ধরে দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সর্বদা কবিতা সৃষ্টির প্রেরণায় ছুটে চলেছেন। তার কবিতা সহজ-সাবলীল গতিসম্পন্ন। তিনি শব্দে-গন্ধে পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন। আলোচ্য ‘ধানের ধাত্রী’ কাব্যগ্রন্থটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তার একটি কবিতা এ রকমইÑ
আমার ভেতরে কেন? বাইরে এসো সোনাভান পাখি
দেখো রুপোর প্লেটে ছড়িয়েছি উড়কি ধান
পেট পুরে খেয়ে নাওÑ ঠোঁট ঘষে উড়ে যাও
আমিতো প্রতিদিন বিনিদ্র রাত্রি জাগি।
ডুমুরের গল্প না হয় শোনাবো একদিন
যেদিন বর্ষার জল ঝাপটা মেরে ভিজিয়ে দেবে
আমার এই পুরনো বাড়ির জানালার কাচ
তখন না হয় কিছু বলা যেতে পারে
ভেতর থেকে বাইরে এসো সোনাভান পাখি
দেখো রুপোর প্লেটে ছড়িয়েছি উড়কি ধান
জানি তুমি রাখবে এই কৃষ্ণ ঋষির সম্মান।
(ছড়িয়েছি উড়কি ধান)
‘দেখো রুপোর প্লেটে ছড়িয়েছি উড়কি ধান’ এমন কথা একজন কবিই বলতে পারেন। ডুমুরের গল্প বলাÑ তাও একজন কবিরই কথকতা।
শামীম তার কন্যাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তার ‘কন্যার প্রতি’ কবিতাটি একটি অতিউৎকৃষ্ট কবিতাÑ তা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। কবিতা লেখার যে অদম্য স্পৃহা তিনি এই কবিতাটিতে ব্যক্ত করেছেন তা তার আপন কবি স্বভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করি। কবিতাটির শেষাংশে তিনি বলেছেনÑ
চাঁদের কুসুমিত পথে হেঁটে যাও তুমি
বেড়ে ওঠো মাটি-ঘাস-তৃণের ভেতর
ঝরাফুল কুড়িয়ে বানাও গহনা তোমার
ঝলমলে ঐশ্বর্যগুলো চোখে মেখো না।
আহা কন্যা আমার! জেনে রেখোÑ
তোমার পিতা ছিল শুধু অক্ষরের দাস।
(কন্যার প্রতি)
এই কবি সত্যনিষ্ঠ এবং একান্ত অর্থেই প্রকৃতি আশ্রয়ী। তাই তার কবিতা পঠনের পাশাপাশি কখনও কখনও আত্মস্থের বিষয় হয়েও দাঁড়ায়। একজন কবির জন্য এটি একটি অনেক বড় বিষয়। শামীম তার একটি কবিতায় উল্লেখ করেছেনÑ
ডানা মেলে জেগে আছে প্রতেœর পাখি
কে তাকে নিয়ে যাবে বসন্তপুর?
স্রোতের উজান ঠেলে কুড়াবে ঝিনুকÑ
গেঁথে দেবে মুক্তোর মালা।
(ডানা মেলে প্রতেœর পাখি)
প্রতœ-ইতিহাস ছাড়া কোন জাতিই অগ্রসর হতে পারে না, একজন কবিতো ননই। প্রতেœর জন্য শামীমের এই আর্তিকে তার কবি স্বভাবেরই একটি অংশ বলে মনে হয়। এ বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘দোল খেয়ে যাও’। এ কবিতায় তিনি বলেছেনÑ
আমাদের নদীশূন্য-বন উজাড়
আছে শুধু ঘাসহীন মরুর নগর
এখন কোথায় পাবো মাদারের গান
কৈশোরের হজমি-দাদুর সুরেলা ডাক!
এবার তবে একটু নেচে গেয়ে
বটের ঝুরি ধরে দোল খেয়ে যাও!
(দোল খেয়ে যাও)
ঐতিহ্য অনুসারী এ কবি ধ্রুপদী চেতনা থেকে অনাগত কালে হেঁটে যাওয়া নক্ষত্রপ্রয়াসী সে পথের রূপমুগ্ধ নিবিষ্ট পথিক। সমকালীন অস্তিত্বের অস্থির আবহে তার তারুণ্য ভাস্কর কলমের উচ্চারিত পঙ্ক্তিমালা স্বতন্ত্র স্বর ও গীতিময়তায় ঋদ্ধ। তিনি যখন বলেনÑ
পলেস্তারা খসা লাল লাল বাড়িগুলো নেই
সেই ধুলোময় পথÑগরুর গাড়ি
সেই আধো আধো আলো নেই!
ঢোপকল জাদুঘরেÑ
কাঁদে তাই হেমন্তকুমারী!
(কাঁদে তাই হেমন্তকুমারী)
তখন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি কতটা ঐতিহ্যাশ্রয়ী। কবিতা এক দ্রুতগামী ঘোড়া। একে আয়ত্তে আনতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে হয়। শামীমের মধ্যে সে প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি লক্ষ্য করেছি। যদি একাগ্রভাবে তিনি সেই সাগর-নদী পার হতে পারেন তবে তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।
শীর্ষ সংবাদ: