ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাহমুদুল বাসার

রণজিৎ সরকারের দু’টি বই ॥ বীরশ্রে

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রণজিৎ সরকারের দু’টি বই ॥ বীরশ্রে

বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প শিশুদের জন্য বই লেখা তাও আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে- বেশ দায়িত্বশীল ব্যাপার। বড়দের বই লেখার সময় অযতœশীলতা বা অসতর্কতা যতটুকু চলে, শিশুদের বেলায় তা হবে আত্মঘাতী। খুব সুন্দর বিষয় যে, রণজিৎ সরকারের ‘বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প’ বইয়ে অযতœশীলতার ছাপ পাওয়া যায়নি। আলোচনার জন্য বইটি এক বসাতেই পড়ে ফেলেছি। বীরশ্রেষ্ঠদের ওপর লেখা পড়েছি বিচ্ছিন্নভাবে। বিভিন্ন পাঠ্য বইয়ে। রণজিৎ সরকারের লেখার ফলে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠদের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ার সুযোগ হলো আমার। পারিবারিক আবহ তৈরি করে শিশুর কৌতূহলজনক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ১৯৭১ সালের বীরশ্রেষ্ঠদের ত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক। এতে শিশুদের উপযোগিতা বিষয়ক, চিন্তা, দর্শন ও শৈশবকাল ফুটে উঠেছে। এক কথায় বলা যায় শিশু মনোবিজ্ঞানের সরাৎসার। দেশ মাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দেশের জন্য আকুণ্ঠ চিত্তে জীবন দানের রক্তাক্ত ইতিহাস গল্পের মতই লিখেছেন লেখক। তার লেখার কৌশল চমকপ্রদ। সংলাপধর্মী কাহিনীগুলো মনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। শুরু করেছেন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে দিয়ে। এই মহান মুক্তিযোদ্ধার সমাধি হয়েছে রাঙামাটিতে। এখানেই বেড়াতে এসেছে এক দম্পতি, তাদের শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। রাঙামাটির সব কিছু দেখা হয়েছে। হঠাৎ পুত্রর মনে হলো বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিস্থান দেখা হয়নি। তারপর তারা সেখানে যান। রউফ সম্পর্কে ওই শিশু নানা প্রশ্ন করতে থাকে, তার বাবা-মাকে। এভাবে শিশুর কৌতূহলের উত্তর দিতে দিতে রউফের ত্যাগের অসামান্য কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ বই পড়ার সময় আমাদের শিশুরা লক্ষ্য করবে যে, বীরশ্রেষ্ঠ রউফ মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পিতৃহীন হওয়ার কারণে, অভাবী সংসারের দায়িত্ব নেয়ার তাগিদে সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলেন। এই যে বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত, টানাপোড়ানের সংসার থেকে বেরিয়ে আসা যুদ্ধ করা। এরাই মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। যারা বলেন, ‘পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশে হতো না,’ তারা কি কথাটা একটু তলিয়ে ভাবেন? বীরশ্রেষ্ঠ সিপাই মোহাম্মদ মোস্তাফা কামাল মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তা পিতা ছিলেন সৈনিক বিভাগের হাবিলদার। একেবারেই সাধারণ পরিবার। এই সাধারণ পরিবারের ছেলেটি যদি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি না হতেন তাহলে কি তাকে কী মনে রাখত কেউ? উচ্চশিক্ষা নয়, ধন নয়, মান নয়, অন্য কোন কীর্তি নয় স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগের কারণে বীরশ্রেষ্ঠরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্বীকৃতি পেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা এমনই ব্যাপক ছিল। যেসব স্তরের মানুষ এতে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই দেখি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান উচ্চ মধ্যবিত্তের হলেও স্বাধীনতার নেশায়, দেশপ্রেম ও নাড়ির টানে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়ে জীবন বিসর্জন দিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুধুমাত্র বিমান বাহিনী গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখে তিনি দেশে থেকে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন বিমান ছিনতাই করতে। এই কাহিনীটি লেখক চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলেছেন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ছিলেন কৃষকের সন্তান। তিনিও মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে মাতৃহীন হয়েছিলেন। ১৩ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। এই সবহারা বীর সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান, বাহিনীর পাশবিক নারকীয় কর্মকা দেখে নূর মোহাম্মদ ঠিক স্থির থাকতে পারেননি। বিবেকের নির্ভুল নির্দেশেই তিনি যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে।’ হ্যাঁ, সাত বীরশ্রেষ্ঠই বিবেকের নির্ভুল নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে সেরা লড়াই চালিয়ে জীবন দিয়ে শ্রেষ্ঠ বীরত্বের হতিহাস রেখে গেছেন। পাঠকের অনুরোধে জানা বা বইটি পড়ে গর্বিত হওয়ার জন্য। ভাষাশহীদদের গল্প শিশুদের উপযোগী বই ‘ভাষাশহীদদের গল্প’। এখানে গল্পের ঢঙে যে সব ভাষাশহীদদের নাম এসেছে তারা হলেনÑ রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বার, সালাম, আউয়াল ও অহিউল্লাহ। কিশোর প্রজন্মের কাছে পরিবারের পিতা-মাতা কিংবা অন্য কোন অভিজ্ঞ অভিভাবকদের মুখে দিয়ে ভাষাশহীদদের জীবনদানের ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক। এমন গৌরবময় রক্তাক্তর ইতিহাস গল্পের আকারের বলার মধ্যে লেখকের মুন্সিয়ানা হচ্ছে সরল, অকপট ভঙ্গিতে গল্পগুলো বলে গেছেন। পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বইটি পড়া শুরু করে থেমে যাওয়া সম্ভব হয়নি আমার। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গবেষণামূলক, রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ ইতিহাস পড়াতেই অভ্যস্ত। ‘ভাষাশহীদদের গল্প’ বইটি পড়াতে শুরু করে খুশি হলাম এ কারণে যে, অনাড়ম্বর গদ্যে লেখক- ভাষাশহীদদের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আমাদের জানিয়েছেন, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা ছিল না। আমাদের আত্মদানকারী-ভাষাশহীদদের সম্পর্কে এত তথ্য জানাতে পেরে লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তার পরিশ্রম ও দেশপ্রেমমূলক ইতিহাস চেতনা কে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই বই লিখতে তিনি রাজনৈতিক টোন ব্যবহার করেননি। তবুও রাজনৈতিক চেতনা এসে পড়েছে। ভাষাশহীদদের পবিত্র মৃতদেহ নিয়ে পাকিস্তান সরকার কি-না কারসাজি এবং হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা এ বইয়ে সুনিপুণভাবে, নিখুঁত বর্ণনায় উঠে এসেছে। পাকিস্তান যে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ছিল তার মুখাকৃতি অঙ্কন করেছেন লেখক পরোক্ষ কৌশলে। তাছাড়া ভাষাশহীদরা কে কোথায় কীভাবে শহীদ হয়েছেন তার জীবন, সচিত্র বর্ণনায় তুলে এনেছেন। এক্ষেত্রেও নিñিদ্র নিখুঁত তথা অবহিত হয়েছে আমাদের, যার অনেক কিছুই জানা ছিল না আমার। তাদের কবর হয়েছে কখন কীভাবে তারও নির্ভরযোগী বর্ণনা পেয়েছি। এত বড় ত্যাগ স্বীকারে যারা অমারত্বের শিলাপাটে নাম লিখে গেছেন, তাদের সব কিছুই আমাদের জানতে ইচ্ছা করে। লেখক সেই দাবি অনেকটাই পূরণ করেছেন। কীভাবে কোন্ পরিবেশে আমাদের ভাষাশহীদদের ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনায় কিংবা তার পরের ঘটনাবলীতে জড়িয়ে পড়লেন তার বিশ্বস্ত বর্ণনা এসেছে। লেখক ভাষাশহীদদের প্রত্যকের ব্যক্তিগত পরিচয় জন্ম তারিখ, পিতা-মাতা স্ত্রী-সন্তান ভাইবোনসহ তাদের আত্মীয়স্বজনের ও পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাগত দিকটিও সবিস্তার তুলে ধরেছে গল্প বলার ঢঙে। আমি নিজেও লেখালেখি করি বলে বোঝাতে পারছি, তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে কতটা পরিশ্রম করেছেন তিনি। শুধু দায়সারাভাবে অথবা চতুরযশ প্রার্থী লেখকদের মতো ইন্টারনেট তথ্যগুলো বসিয়ে দেননি। কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতা থেকে পরিমিত তথ্য দিয়ে ঘটনাগুলো এমনভাবে বলে গেছেন যেন শিশুদের কোমল হৃদয়ে চেতনার ফুল ফোটে। লেখার কী সার্থকতা যদি-পাঠকের মনে চেতনার বীজ বপন না করে? রণজিৎ সরকারের এ বইটি পড়তে পড়তে আমি নিজেও শিশুদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। যেন আমি বাবার মুখ থেকে- রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বার, সালাম, আউয়াল ও অহিউল্লাহর জীবন বিসর্জনের গল্প শুনেছি। লেখককে সাধুবাদ জানাই। তার বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।
×