ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ ও তিনের অনুপাত ॥ হেজাবি ও মুক্তিযোদ্ধা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাঁচ ও তিনের অনুপাত ॥ হেজাবি ও মুক্তিযোদ্ধা -স্বদেশ রায়

সম্প্রতি দুটি সংখ্যা খুব আলোচিত হচ্ছে : একটি পাঁচ, অপরটি তিন। জাতীয় জীবনে কখনও কখনও এই ধরনের কোন সংখ্যা বা উপাত্ত এসে উপস্থিত হয়। সেটাকে কোনরূপ গুরুত্ব না দিয়েও মানুষ তার সময় পার করে দিতে পারে। কিন্তু জাতির ভবিষ্যত চিন্তা করতে হলে এ ধরনের সংখ্যা বা উপাত্ত যখন দেখা দেয় তখন গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। সংখ্যাটি কেন পাঁচ ও তিন হয়ে জাতির সামনে এলো। সংখ্যাটি তিন ও পাঁচ হয়েও জাতির সামনে আসতে পারত। কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কোন ক্ষেত্রেও সেটা আসবে না। কেন আসবে না; এর উত্তর খুঁজতে গেলে মুনতাসীর মামুনের চিন্তাকে উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের এলিট ক্লাস বা বিভিন্ন উঁচু স্থান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রায় সকলের ভেতর একটি হেজাবি (হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপি) মন আছে। এই হেজাবি মনের বাইরের সংখ্যা খুবই কম। আসলে বাংলাদেশে শিক্ষিত সমাজে হেজাবি মন ও মুক্তিযোদ্ধা মনের সংখ্যার অনুপাত কিন্তু মোটামুটি পাঁচ তিন। মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে এমন সত্য খুব নির্মমভাবে অনেকক্ষেত্রে বেশ আগেই বলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকে তাঁকে এজন্য মামুন ফকির বলেন। কারণ, তিনি আগেই পীর-ফকিরের মতো ভবিষ্যদ্বাণী করে দেন। তাঁর এই বলতে পারার উৎসটি কিন্তু কোন পীর-ফকিরের কেরামতি নয়, তাঁর লব্ধ জ্ঞান। তিনি বাঙালী জাতির দুই হাজার বছরের ইতিহাস পড়েছেন। কয়েক শ’ বছরের ইতিহাস লিখেছেন। জাতির এই ইতিহাস ঘেঁটে তিনি এ জাতির চরিত্রটি জেনেছেন কষ্টি পাথরে যাচাই করে জানার মতো। তাই জাতির চরিত্র ধরেই তিনি বিচার করেন মানুষের চরিত্র, উপাত্ত অনুযায়ী সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তাঁর জন্য সহজ হয়। যে কারণে তিনি লিখেছেন, বাঙালী জাতিগতভাবে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে। অর্থাৎ অনুপাত বর্তমানের আলোচিত হেজাবি পাঁচ ও মুক্তিযোদ্ধা তিনের মতো। বাংলাদেশের এই হেজাবি মনকে অনেকে বলেন পাকিস্তানী মনা। আসলে যারা পাকিস্তানী মনা তারাই কিন্তু হেজাবি। বাংলাদেশে এই পাকিস্তানী মনার সংখ্যা আদৌ কম নয়। অন্তত এলিটদের ভেতর এরা বেশি। যে কারণে, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করার জন্য এলিটদের ওপর খুব কম ভরসাই করেছিলেন। আর এ কথা তো সত্য- কিছু এলিট বেতন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, বাদবাকি না খেয়ে, নিজের জীবন বাজি রেখে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারা গ্রামের দরিদ্র কৃষক আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়তে আসা কৃষকের সন্তান। বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনাও এ সত্য জানেন। এই মাত্র কয়েকদিন আগেও ব্যক্তিগত আলোচনায় তিনি বললেন, ‘আমার কাছে এই সব বড় বড় তথাকথিত ধনীদের থেকে আমার একজন গ্রামের দরিদ্র কর্মী অনেক বড়।’ অনেকে অবশ্য বলতে পারেন, কিন্তু তার পরেও তো দেখা যায়, শান্তি কমিটির সদস্য বগা মিয়াদের নিয়ে শেখ হাসিনাকে অনেক কাজ করতে হচ্ছে। এদের সম্পর্কে শেখ হাসিনা অনেক আগেই বলেছেন, টিম জেতার জন্য আমাদেরকে প্লেয়ার হায়ার করতে হয়। তাছাড়া এই ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুরও ছিল, শেখ হাসিনারও আছে, তিনি বগা মিয়াদের দিয়েও কাজ করাতে পারেন। আর এখানে শেখ হাসিনা কৌশলী বলে বগারা একটা পর্যায়ের পরে আর যেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু অতটা কৌশলী ছিলেন না বলে মোশতাক তাঁর কাছে চলে গিয়েছিল। এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশে এত বছর পরেও কেন এই হেজাবি বা পাকিস্তানী মনারা? অনেকে অনেক কথা বলেছেন। যেমন, রফিকুল ইসলাম স্যার তখন যায়যায়দিনে টেলিভিশন সমালোচনা লিখতেন। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোন টিভি ছিল না। মুনওয়ার বখত নামে লিখতেন তিনি। স্টেডিয়ামে পাকিস্তানীদের একটি খেলায় বাংলাদেশের একশ্রেণীর তরুণের পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা দেখে, তিনি লিখেছিলেন, গ্যালারিতে পাকিস্তানের পক্ষে এত বাংলাদেশের তরুণ দেখে দ্বিধায় পড়ে যাই; এরা কোথা থেকে এলো? পরে বুঝতে পারি, রাজাকার, আলবদররা পাকিস্তানী সৈন্যদের বাসায় নিয়ে নানান ধরনের আপ্যায়ন করত ওই সৈন্যরাই মনে হয় এই তরুণদের রেখে গেছে। রফিকুল ইসলাম স্যারের ওই কথা অনুযায়ী যদি ধরা হয়-আর তারপর বর্তমান অনুপাত যখন পাঁচ তিন হয় তখন নিশ্চয়ই সব যে সৈন্যদের রেখে যাওয়া তা নয়। তাহলে এরা কোত্থেকে আসছে? আসলে এখানেই ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য- যা এ কলামে বার বার লিখেছি। ইউরোপে কোন যুদ্ধাপরাধীর সন্তান যুদ্ধাপরাধী হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে সব যুদ্ধাপরাধীর সন্তানই যুদ্ধাপরাধী। আর রাজাকার, আলবদরের বিষয়ে বলতে গেলে এখানেও আবার মুনতাসীর মামুনের বক্তব্য নিয়ে বলতে হয়, একবার যে রাজাকার সে সারা জীবন রাজাকার। অনেকে বলতে পারেন, খেলাকে সাপোর্ট করার ভেতর রাজনীতি বা জাতীয় চরিত্র টেনে আনা ঠিক নয়। এ ধরনের কথা শুনতে ভাল লাগে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের দূরদৃষ্টি অসাধারণ। আরেকটি ক্ষেত্রে তিনিই বাংলাদেশে একক যিনি ছোটবড় সকল লেখক, সাংবাদিককে বটবৃক্ষের মতো আশ্রয় দিয়েছেন। তা সে বৃহৎ মহীরুহ সৈয়দ শামসুল হক থেকে ধূলিকণা স্বদেশ রায় পর্যন্ত। তরুণ বয়সে যখন তাঁর ছায়ায়- একদিন তিনি আমাকে বললেন, দেখ তুমি অমুকের সঙ্গে মেলামেশা করো, কিন্তু মনে রেখো, ও কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের সাপোর্টার। এর পরে সাংবাদিক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করি, উনি তো নতুন পত্রিকা করছেন, আমাকে ভালবাসেন খুবই- ওনার পত্রিকায় যেতে চাই। গাজী ভাই বললেন, ওই পত্রিকায় তুমি নিজেকে শেষ পর্যন্ত মেলাতে পারবে না। ওই পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে না। কারণ, ও তো পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের সাপোর্টার। বাস্তবে ওই পত্রিকা কিন্তু এখন মু্িক্তযুদ্ধের আদর্র্শের পক্ষে নেই। এই বাস্তবতা কি আমাদের চিরকাল মেনে নিয়ে চলতে হবে? আমরা কি এই পাঁচ তিন অনুপাত থেকে বের হয়ে শতভাগ হতে পারব না মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে? এর জন্য কি কোন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে, শুদ্ধি বিপ্লব করতে হবে; না, অন্য কিছু করতে হবে? শুদ্ধি বিপ্লব একটি চলছে। শেখ হাসিনা তার নেতা। তবে এখানে নেতার চরিত্রটি বাতাসের মতো। অর্থাৎ বাতাসের ভেতর বাস করে যেমন আমরা বাতাসের গুরুত্ব প্রতিমুহূর্তে কতখানি তা বুঝতে পারি না, এ ক্ষেত্রেও তেমনটি। কারণ, শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে শুদ্ধি বিপ্লবের পথ তৈরি করে দিচ্ছেন। যেমন শেখ হাসিনা আছেন বলেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। বাংলাদেশে এ যাবৎ যত নেতা এসেছেন, অন্য কারো দ্বারা এভাবে এই বিচার সম্ভব ছিল না। শেখ হাসিনা আছেন বলেই কিন্তু শাহবাগ বসন্ত হয়েছে, আবার পরিবেশ এতই প্রতিকূল হয় যে, শাহবাগ স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু শাহবাগে যে নতুন প্রজন্ম এসেছিল তারা কিন্তু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের বুকের ভেতর শাহবাগ আছে। ওই সব তরুণের বুকের ভেতর থাকা শাহ বাগিচার ওই ফুলকে এখন আরও ফোটাতে হবে। তরুণ প্রজন্মকেই কিন্তু এখন এদেশের মানুষকে, এদেশের এলিট শ্রেণীর ওই অংশকে হেজাবি বা পাকিস্তানী মন থেকে বের করে আনতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে এ জন্য সংগ্রামী হতে হবে। তাদেরকে রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্তকণ্ঠে বলতে হবে, ‘বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে।’ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান প্রতিকূল পরিবেশে বিকেল চারটার ভেতর শেষ করার আইন করেছে সরকার। তরুণদের এখানে সূর্যেরও ঘুম ভাঙ্গাতে হবে। ভোর হওয়ার আগে সারাদেশে লাখ লাখ তরুণকে রাস্তায় নেমে আসতে হবে। তবে হেজাবি মন থেকে বের হওয়ার জন্য সব থেকে বড় প্রয়োজন, নিজের একটা বাস্তববাদী আধুনিক মন গড়া। এর জন্য দরকার লেখাপড়া। যেমন আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছি -ইতিহাস পড়তে হবে, বাঙালীর ইতিহাস পড়তে হবে, পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস পড়তে হবে (যার মধ্যে আছে বিজ্ঞানের ইতিহাস, দর্শনের ইতিহাস, অর্থনীতির ইতিহাস)। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী গত সাত বছর এ কথা শুনতে পাননি, বরং কখনও শুনলে তিনি চেয়ার থেকে রেগে লাফিয়ে উঠেছেন। এখন রামের সুমতি হয়েছে। তিনি এখন প্রতিটি বক্তৃতায় বলছেন, জঙ্গী (বাস্তবে এরাও হেজাবি) থেকে মুক্তি পেতে হলে ইতিহাস পড়তে হবে। বাস্তবে গত সাত বছর ধরে শেখ হাসিনাকে যে সমুদ্র পাড়ি দিতে হচ্ছে, সেখানে তাঁর ভুল ধরতে যাওয়া আরেক অন্যায়। তারপরেও রাষ্ট্র যেহেতু তাঁর হাতে অতএব তাঁকে এ কাজ করতেই হবে। পৃথিবীর জ্ঞানের রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশকে যোগ করাতে হবে তাঁকে। আমাদের পশ্চিমে অনেক আগে আধুনিক সভ্যতা এসেছে। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে বলে গেছেন, পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার। এখন পূর্বেও সভ্যতা এসেছে। পূর্ব এশিয়া শুধু অর্থনীতিতে উন্নতি করেনি; সাহিত্যে, কলায়, বিজ্ঞানে সব কিছুতেই তারা উন্নতি করছে। তাই পূর্ব ও পশ্চিমের সভ্যতার দুয়ার খুলে দিতে হবে। শুধু কম্পিউটারে ট্যাক্স তুলে দিলে হবে না সারা পূর্ব-পশ্চিম সব খানের চিন্তা যাতে বাংলাদেশের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের হয়ত সব সময় মনে থাকে না, শুধু তাই নয়, আমাদের সরকারের সিস্টেমটাই কোন কিছু না করে সারাক্ষণ কাজের ভেতর আছি, এটা দেখানো। তরুণদের তাই আদায় করে নিতে হবে। কারণ, এই তরুণদের, এই নতুন প্রজন্মকে এখন এমনভাবেই তৈরি হতে হবে। যাতে তার অর্জিত জ্ঞান তার বিবেককে সাহসী করে। জ্ঞান ছাড়া কোন মানুষ সাহসী হয় না। জ্ঞানহীন মানুষ বদরাগী হতে পারে, গোঁয়ার হতে পারে- সাহসী হতে পারে না। জ্ঞানই একমাত্র মানুষকে সাহসী করে। সুবিধাবাদিত্ব থেকে দূরে থাকার মতো ব্যক্তিত্ব গড়ে দেয়। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে পূর্ব ও পশ্চিমের সঙ্গে সমানতালে পা ফেলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। তখন দেখা যাবে তাদের মনের ভেতর জ্বলে ওঠা আলোই মন থেকে হেজাবিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এই আলোকিত তরুণ প্রজন্ম যখন রাষ্ট্রের সবখানে বসবে তখন আর আমাদের পাঁচ ও তিনের অনুপাত দেখতে হবে না। [email protected]
×