ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট-২০১৬ এবং মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট-২০১৬ এবং মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা

গত ২২ আগস্ট বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৬’ শীর্ষক একটি খসড়া আইনের অনুমোদন দিয়েছে। এ আইনের একটি অংশে জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত তথ্য প্রকাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে নেতিবাচক অপপ্রচারের জন্য শাস্তির প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া আদালত দ্বারা স্বীকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কোন তথ্য কেউ বিকৃত করলে একই ধরনের সাজার বিধান এ আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। খসড়া আইনের ১৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিদেশী নাগরিক যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন অবমাননাকর মন্তব্য, প্রচার বা অপপ্রচারে লিপ্ত হয় বা সেটাতে মদদ প্রদান করে; তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিদেশী নাগরিক ডিজিটাল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটনের অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ অনুচ্ছেদ ১৬ ধারাতে ১৫ ধারার অধীন অপরাধের জন্য শাস্তি ৩ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পুরো আইনের এই অংশটা অনেক প্রতীক্ষিত দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের প্রচারাভিযানের ফল, যে প্রচারাভিযানে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তবে, আমাদের এ দুর্ভাগা দেশে অন্য যে কোন ইস্যুর মতোই, এই ধরনের একটি আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে সমালোচনা উঠছে। সমালোচকদের সমালোচনা মূলত দুটি বিষয় নিয়ে : প্রথমত. এটা মুক্তচিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করবে এবং যার ফলে আমাদের ইতিহাসের ওপর গবেষণাকে সীমিত করবে; দ্বিতীয়ত. তাদের মতে, আইনটি অপ্রয়োজনীয়, যেহেতু কেউই আমাদের সত্যিকার ইতিহাস বিকৃত এবং বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে পারবে না। মুক্ত চিন্তা/বাকস্বাধীনতা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। এটা জনস্বার্থে জনগণের মাঝে বিভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময় মতামত পরিবেশনে উৎসাহ দেয়। কিন্তু সব ধরনের স্বাধীনতার মত; এটা শর্তহীন নয় এবং সেটা উচিতও নয়। বাকস্বাধীনতা একদিকে অন্য কারো প্রতি ঘৃণা প্রকাশের সম্ভাব্য অস্থিতিশীল প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং অন্যদিকে অন্যের আবেগ বা অনুভূতিকে যেন আঘাত না করে সে ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ করা আবশ্যক। উপরন্তু, কানাডিয়ান বিচারপতি এমএ বাইন্ডারের ভাষায়, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’ বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই বলে যারা চিৎকার করেন তারা কি জানেন পৃথিবীর কোন প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে সে দেশের স্বীকৃত ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের বল্গাহীন বক্তব্য দিয়ে রাজনীতি করা যায় কি-না? গত বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অফিসিয়াল মৃতের সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করে ইতিহাসকে অবমাননার অপরাধে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী এক সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে। মাননীয় বিচারক বার্গম্যানের ২০১১ সালের একটি ব্লগ পোস্টে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ২০১১ সালের নবেম্বর দেয়া ঐ পোস্টে তিনি সেখানে মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে মতামত দেন এবং সরকারী সংখ্যার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেন। ট্রাইব্যুনালের প্রিসাইডিং বিচারক ওবায়দুল হাসান ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া তাঁর রায়ে বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরল বিশ্বাসে এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডেভিড বার্গম্যানের তন্ন তন্ন করে খুঁজে এ সংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করার পেছনে সরল বিশ্বাস ছিল না এবং এটা তিনি জনস্বার্থ রক্ষার জন্য করেননি।’ ট্রাইব্যুনাল পুনর্ব্যক্ত করেন, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং এটা বাংলাদেশের জনগণের ‘আবেগের সঙ্গে জড়িত’। ট্রাইব্যুনাল এছাড়া এই সংখ্যা (তিরিশ লাখ) ট্রাইব্যুনালের দেয়া আগের আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ‘যে কেউ এই গবেষণা করতে পারেন কিন্তু তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের মর্যাদায় আঘাত হতে পারে এমন ধরনের কোন মন্তব্য করার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে’ মাননীয় বিচারক এই মন্তব্যটি যোগ করেন। খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করার পরের দিনই বিএনপিপন্থী এক ‘বুদ্ধিজীবী’ একটি সেমিনারে বলেন, ‘৭১ সালে আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। হিস্ট্রি এটাই। আপনি যতই ইতিহাস লেখেন আর আদালতের রায় দেন কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে না। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে। তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি।’ প্রাক্তন চীনপন্থী এই লোকটি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেটা আমার মতো অনেকেরই জানা ছিল না। তার ‘আদর্শের’ লোকেরা তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এ ধরনের অর্বাচীন প্রগল্ভতা কি মুক্তচিন্তা-গবেষণার ফসল? এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রাণীদের মুক্তচিন্তা দিয়ে সত্য আবিষ্কারকে খর্ব করা নিয়েই কি আইনের সমালোচকরা শঙ্কিত? এসব তথ্যসন্ত্রাসীকে শায়েস্তা করার তিনটি পথ আছে : এক. মধ্যযুগীয় পন্থা, দুই. পাগলা গারদে প্রেরণ, তিন. আইনের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান। মুক্তিযুদ্ধ যারা হৃদয়ে ধারণ করেন তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত তথ্য প্রকাশের বিরুদ্ধে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। কিছু ‘সুশীল’ মহোদয় এ আইনের সমালোচনায় নেমেছেন। আমার প্রশ্ন, আইনের মাধ্যমে শাস্তি না দিয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় পন্থা নিলে কি তারা খুশি হবেন? আমাদের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ ধরনের অমার্জনীয় মিথ্যার ফুলঝুরি ১৯৭৫ আগস্ট মাসের সে কালরাত থেকে চালু করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে তার নিজের সৃষ্ট ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা হয় এবং তিনি ছিলেন দেশে একটি ডি ফ্যাক্টো নিষিদ্ধ নাম। বিএনপি চেয়ারপারসন গত ডিসেম্বরে এক প্রকাশ্য ভাষণে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না।’ হ্যাঁ, বলেছেন সেই মহিলা যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনা ছাউনিতে অবস্থান করছিলেন অনেকটা আতিথেয়তায়। তার সাধের পাকিস্তান ভাঙ্গার জ্বালা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। খালেদা জিয়ার মন্তব্য দিলেন এমন সময়ে যার কিছুদিন আগে নবেম্বরে ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয় মাসের যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে কোন গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা নৃশংসতা ঘটায়নি’ ধরনের পাকিস্তানের অস্বীকৃতির পর পরই এবং ১৯৭১-এ শহীদদের সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এর পর পরই খালেদা জিয়ার এক অনুসারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বললেন ‘নির্বোধ’ এবং আর একজন বললেন, ‘যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির মাঝে উপস্থিতই ছিলেন না তাঁকে বানানো হয়েছে জাতির পিতা।’ এ সমস্ত মুক্তচিন্তাবিদ-গবেষকের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা খর্ব করা নিয়েই কি প্রস্তাবিত আইনের সমালোচকরা শঙ্কিত? গত বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাজার পর আদালতে তিনি যে চরম অভদ্রতার প্রকাশ ঘটান এবং তথাকথিত ৫০ বুদ্ধিজীবীর বিবৃতিতে প্রায় সব স্বাক্ষরদাতাই বার্গম্যানের ব্লগে কিভাবে আমাদের শহীদের সংখ্যা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, তিনি কিভাবে ট্রাইব্যুনালকে উপদেশ দিয়েছেন, তাদের কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় (ভাবখানা বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ কলোনি) এবং বার্গম্যানের সাজার রায় না পড়ে এবং সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেই ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ স্বপক্ষে বিবৃতি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ইউরোপের ১৪টি দেশে ‘হলোকস্ট অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’ এর মতন ‘গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’ প্রণয়নের দাবি ওঠে। ঐ আইন অনুযায়ী ১৯৩০ এবং ১৯৪০ সালে নাৎসি জার্মানি ইউরোপে সুপরিকল্পিত জাতিগত লাখ লাখ সংখ্যালঘু নিধনকারী গণহত্যাকে অস্বীকার করা আইনের লঙ্ঘন। অনেক দেশে গণহত্যা অস্বীকারকে অপরাধ গণ্য করে বৃহত্তর আইন হয়েছে। অনুরূপভাবে, বেগম জিয়ার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের অর্বাচীন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাপরাধের গবেষক এবং যুদ্ধে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন, যুদ্ধাপরাধ প্রসিকিউটর এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংস্থাগুলো মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন অবমাননাকর মন্তব্য নিরোধে শাস্তির বিধান করে একটি আইন প্রণয়নের পক্ষে আরও জোরাল দাবি ওঠে। কিছু মানুষ বাকস্বাধীনতার নামে, কোন এক বিশেষ উদ্দেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। তারা এক অসৎ উদ্দেশে আমাদের ত্যাগ এবং উৎসর্গকে লঘুকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে সুচতুরভাবে আমাদের জনগণের ওপর সংঘটিত অপরাধকে যৌক্তিকতা দানের প্রয়াসী। সবচেয়ে প্রচারিত হলোকস্ট অস্বীকার বিচারটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রিয়াতে। এক অস্ট্রীয় আদালত ব্রিটিশ লেখক ডেভিড আরভিংকে দোষী সাব্যস্ত করে যিনি অস্বীকার করে লিখছিলেন যে অঁংপযরিঃ এবং অন্যান্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যারা মারা গেছে তাদের অধিকাংশকেই গ্যাস বা অন্য কোন উপায়ে হত্যা করা হয়নি; তারা সংঘটিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি ৬ মিলিয়ন ইহুদী নিহত হওয়া বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। মাত্র একদিনের শুনানি শেষে আরভিংকে তিন বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয় যদি তিনি তার আগের গবেষণা থেকে সরে আসেন যেখানে তিনি গ্যাস চেম্বারের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে চলেছিলেন। পাশ্চাত্য সমাজের রাজনৈতিক অঙ্গনে আপাতদৃষ্টিতে উচ্চতর নৈতিক মূল্যবোধের প্রয়োগ সত্ত্বেও এ অস্বীকার আইন এবং তার প্রয়োগ ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি দুই দোষী সাব্যস্ত যুদ্ধাপরাধীর পুত্ররা, যারা তাদের পিতাদের ধর্মপ্রাণ রাজনৈতিক শিষ্য, বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে স্থান পেয়েছে। এমনকি সাকা চৌধুরীর মতো চরম ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হওয়ার পর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে তার মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। পাশ্চাত্যে এমন কোন একটি পরিস্থিতি বা ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল তার নিজের কবর খনন করবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির প্রধান শক্তি এবং আত্মা। যে কেউ দেশে এবং বিদেশে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয় মাস সময়ে এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য যা কিছু করেছেন, এটা তার নাম আবাহন করেই করা হয়েছে। তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি জাতিকে একত্রিত করে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন যেটা অতীতে কিংবা তার পরে কেউই করত পারেননি। নয়টি মাসের গণহত্যা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং অবর্ণনীয় কষ্টের সময়ে, তার নাম লাখো কোটি হৃদয়ে রাতদিন ছিল সমুজ্জ্বলিত। ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ একটা জাতির নেতৃত্ব দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্যের জন্য একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এ গৌরবময় ইতিহাস ব্যবহার হতে পারত জাতিকে তার মিলনস্থলে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান বাণী সৃষ্টিতে। তার বিপরীতে ইতিহাসকে বিকৃত করে ঈপ্সিত এবং লালিত জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন রয়ে গেছে এক বিভ্রমে। একবার আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক প্রয়াত লি কুয়ান ইউকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার দেশে এত কঠিন আইন কেন? তার উত্তর ছিল, ‘বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন কোন জনগোষ্ঠী সভ্য আর দায়িত্বশীল হতে ব্যর্থ হয় তখন সেটা আইনের মাধ্যমে করতে হয়।’ বস্তুত, এই ধরনের কঠিন আইন দিয়ে সভ্য আর দায়িত্বশীল বানানোর কারণেই তাঁর দেশটি আজ আমাদের গ্রহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ২০ জুন এক যুগসন্ধিক্ষণ রায়ে, যেটাতে বঙ্গবন্ধুই যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা আইনগতভাবে সুনিশ্চিত করে। মহামান্য হাইকোর্ট অধিকন্তু উল্লেখ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের একটি অসত্য সংস্করণ প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় জড়িতদের সরকার বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে পারে। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের মতে ইতিহাসকে নিয়ে কাল্পনিক এবং অসত্য প্রচারকে জাতি ও সংবিধানের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। বর্তমান খসড়া নিরাপত্তা আইনটি, জনমানুষের ঈপ্সিত দাবি মেনে নেয়া ছাড়াও, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহারের অজুহাতে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস এবং সে ইতিহাস সৃষ্টির রাখাল রাজা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ঘৃণ্য মিথ্যা প্রচারে লিপ্তদের মোকাবেলা করতে দেশের সাংবিধানিক আদালতের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×