ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া, সর্বত্র বিস্ময়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৫ জুলাই ২০১৬

হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া, সর্বত্র বিস্ময়

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে দুই যুবকের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ায় সর্বত্র বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মান্ধতা কোন অস্বাভাবিক এবং নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্ত ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়েছে, এ ধরনের আরও কিছু যুবকের ধর্মান্তরের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে, যা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে এবং তাদের অবস্থানের খোঁজ খবর নিয়ে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার সাংবাদিকদের বলেছেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এ যুবকরা ধর্মান্তরিত হয়ে এমন সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হবে তা সাধারণত ভাবনায় আসেনি। তবে তাদের নানাভাবে প্রলোভনে ফেলে বা মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গীপনায় জড়িত করা হয়েছে বলে আপাতত ধারণা করা হয়েছে। ধর্মান্তরিত দুই যুবকের জঙ্গীতে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা এখন বেশ আলোচনার এবং একইসঙ্গে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গী হওয়ার জন্যই ধর্মান্তর নাকি ধর্মান্তরিত হওয়ার পর কোন কারণে এরা জঙ্গীতে পরিণত হলো তা নিয়েও রয়েছে বিশ্লেষণ। তবে জঙ্গী নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, ধর্মান্তর ও জঙ্গী হওয়াকে একসঙ্গে মেলানো ঠিক নয়। জঙ্গীদের সংস্পর্শে গিয়ে ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা জঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। আলোচনায় এখন সীতাকু- থেকে আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এটিবি) সদস্য মুসয়াদ ইবনে উমায়ের (২৫) এবং ঢাকার গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকা-ে জড়িত নিখোঁজ জঙ্গী সাইফুল্লাহ ওজাকি। প্রথমজনের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ছনহরা গ্রামে। আর সাইফুল্লাহর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবী নগরের জিনদপুর গ্রামে। এ দুজনই হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন। পুলিশ জানায়, পটিয়ার উমায়েরের আগের নাম পিকলু দাস। সে অরুণ কান্তি দাশ ও ঝর্ণা দাশের পুত্র। পুলিশ প্রথমে তাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গী হিসেবেই গ্রেফতার করে। পরে তার আসল পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, কলেজে অধ্যয়নকালে হ্যাপী নামের মুসলিম এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পিকলু ধর্মান্তরিত হয়ে উমায়ের নাম ধারণ করে। ২০১১ সালে সে বাড়ি ছাড়ে। এর আগে ২০১০ সালের শেষের দিকে তাদের বাড়িতে ৩ জন মুসলিম যুবকের নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল। তারা ছিল পিকলুর বন্ধু। রুদ্ধদ্বার আড্ডায় তারা কি আলাপ আলোচনা করত তা বাবা-মা জানতেন না। তবে ছেলের বন্ধু হিসেবে এ তিন যুবককেও তারা পুত্রের মতোই দেখতেন। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বাড়ি ছাড়ার দুদিন পর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা পিকলুর ডায়েরি পড়ে জানা যায় হ্যাপী নামের একটি মেয়ের নাম। ডায়েরিতে পিকলু লিখেছেÑ ‘মালিক আল্লাহ’। হ্যাপী নামক মুসলিম মেয়েকে ভালবাসি। তাকে বিয়ে করতে মুসলিম হব। পিকলুর বাবা চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজারে ব্যবসা করতেন। শহরে বাসা নিয়ে পরিবারটি বসবাস করত। সে ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পরে ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়। তবে ধর্মান্তরিত হয়ে বাড়ি ছাড়ার পর তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। আলোচিত আরেকজন হলো সাইফুল্লাহ ওজাকি। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জিনদপুর ইউনিয়নের জনার্ধন দেবনাথের পুত্র। আগে তার না ছিল সুজিত চন্দ্র দাশ। অত্যন্ত মেধাবী সুজিদ সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর জাপান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান ওই দেশের এশিয়া প্যাসিফিক ইউনির্ভাসিটিতে। ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর শেষ করে ওই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে এক ব্যবসায়ীর কন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরে দু’জনই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। জাপান থেকে মাঝে মধ্যে দেশে এলেও তিনি নিজ বাড়িতে না থেকে অন্য বাড়িতে থাকতেন। অন্যের ধরাছোঁয়া কোন কিছুও খেতেন না সাইফুল্লাহ। গ্রামের বাড়িতে ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায় এলাকার অনেকেই জানত না যে, সুজিত ধর্মান্তরিত হয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঈদ জামায়াতে হত্যাকা-ের পর পুলিশ নিখোঁজ জঙ্গীদের যে ছবি প্রকাশ করে, তাতেই আলোচনায় আসেন সাইফুল্লাহ ওজাকির (সুজিত চন্দ্র দাশ)। জঙ্গী হিসেবে তার ছবি আসায় হতবাক হয়ে যায় তার গ্রামের মানুষ। প্রশ্ন হলো, ধর্মান্তরিত হয়েই জঙ্গীতে রূপান্তর কেন। তারা কি জঙ্গী হওয়ার জন্যই ধর্মান্তরিত হয়েছিল? কেউ কেউ এমন ভাবলেও তা মনে করছে না বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের মতে, ধর্ম পরিবর্তন নানা কারণে হতে পারে। কেউ তার নিজস্ব চিন্তা থেকে আবার কেউ বা প্রভাবিত হয়ে বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারেন। এর সঙ্গে জঙ্গী হওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নয়। তবে কাদের মগজ ধোলাইয়ে ধর্মান্তরিত হলো বা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর কাদের দ্বারা প্রভাবিত হলো সেটিই দেখার বিষয়। তবে ধর্মান্তরিতদের তুলনামূলকভাবে সহজে ব্যবহার করা যায়। এ ধরনের আরও ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে কিনা আর ঘটলেও এখন তারা কোথায় এবং স্বাভাবিক জীবনে রয়েছে কিনা তার অনুসন্ধান করছে পুলিশ। এমন নয় যে, সকলেই উমায়ের কিংবা সাইফুল্লাহর মতো পথে গেছে। তবে তাদের খোঁজ করা জরুরী। পুলিশ জানায়, তাদের কাছে ধর্মান্তরের আরও কিছু তথ্য রয়েছে। পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। আর সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের চেষ্টাও চলছে।
×