ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুলশান ট্র্যাজেডি

অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়াও ছিল হামলার লক্ষ্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৫ জুলাই ২০১৬

অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়াও ছিল হামলার লক্ষ্য

আরাফাত মুন্না ॥ শুধু ভাবমূর্তিই নয়, দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়াও ছিল গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, হামলায় নিহত ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশী নাগরিক। এদের মধ্যে ৭ জন বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালনকারী জাপানের নাগরিক। তাদের মধ্যে ৬ জন দেশে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষক। ভারতের ১ জন ছাড়া বাকি নয় জন ইতালির নাগরিক। এদের মধ্যে ৬ জনই হচ্ছেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের ক্রেতা, যারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করেন। শুধু বিদেশীদের টার্গেট করা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলাও ছিল এই হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মেগা ১০ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে তার একটি হলো মেট্রোরেল। এই রেল ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। ফলে পূর্ণ গতিতে শুরু হবে এ রেল ব্যবস্থার নির্মাণ কাজ। এ লক্ষ্যেই জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার পক্ষে এই বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে এসেছেন এই প্রকল্পের কাজ তদারকি করতে। তারা হচ্ছেন, কাটাহিরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনালের পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কিউ ওগাসারা (৫৬), যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মাকোতো ওকামোরা (৩২), এলমেক কর্পোরেশনের প্রকৌশলী ইউকো সাকাই (৪২), একই সংস্থার প্রকৌশলী রিও সিমোদারিয়া (২৭), জাইকার নির্মাণ বিশেষজ্ঞ হিরেসি তানাকা (৮০), জাইকার কর্মকর্তা নবহিরো কুরসাকি (৪৮), জাইকার কর্মকর্তা হিদেকি হাসিমুতো (৬৫)। আর বেছে বেছে তাদেরই জিম্মি করে হত্যা করা হয়েছে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এ খাত থেকে। আবার এককভাবে এ শিল্প খাতটিও সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আর এ রফতানি আয়ের পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে যারা কাজ করছেন তারা হলেন বিদেশী ক্রেতা। তারা এদেশ থেকে তৈরি পোশাক কিনে বিদেশের বড় বড় সুপার স্টোরগুলোতে সরবরাহ করে থাকেন। অনেক বিদেশী ক্রেতা এদেশে তাদের বাইং হাউস স্থাপন করে এদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকেন। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় যে নয় ইতালীয় নাগরিককে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করেছে জঙ্গীরা তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা। ইতালির নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন- বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ী মার্কো টোনডাট, ভিনসেনজো ডেলাসত্রো (৪৬), গার্মেন্টস ক্রেতা মারিয়া রিভোলি (৩৩), গার্মেন্টস বাইং হাউসের এমডি নাদিয়া বেনিডিট (৫২), বস্ত্র খাতের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার এডেলি পুগ্লেসি (৫০), গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ক্লডিও কাপ্পেল্লি (৪৫), গার্মেন্টস বাইং হাউসের ম্যানেজার ক্রিষ্টিয়ান রোসি (৪৭), ফিডো ট্রেলিং লিমিটেডের এমডি ক্লডিয়া মারিয়া দান্তোনা (৫৬), টেক্সটাইল ফার্মের কর্মকর্তা সিমোনা মন্টি (৩৩)। এছাড়া একজন ভারতীয় ছাত্রী তারুশি জৈন (১৯)। বাংলাদেশের ৩ জন হলেন মানবসম্পদ কর্মকর্তা ইশরাত আকন্দ (৪৫), ফারাজ আইয়াজ হোসেন (২০) এবং অবিন্তা কবির (১৯)। জঙ্গীদের টার্গেট ছিল না বাংলাদেশীরা। তারা দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনার শিকার হয়েছেন। জঙ্গীদের মূল টার্গেট ছিল বিদেশীরা। তাদের টার্গেট করা হয়েছে মূলত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা ও দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিদেশ নির্ভর। রেমিটেন্স ও রফতানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে টেনে উপরে তুলছে। আবার বিদেশী বিনিয়োগও দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখছে সৃষ্টি করছে কর্মসংস্থান। তাই কোনভাবে বিদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভীতি তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশকে পঙ্গু করা যাবে। আর সেই উদ্দেশ্য থেকেই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বেছে বেছে বিদেশীদের হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উন্নয়নে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোই যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসারিত করছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে আর এগুলোকে ঠেকাতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারকে বেকায়দায়-চাপে ফেলার উদ্দেশ্যেই এ হামলা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ ধরনের হামলার উদ্দেশ্য হলো বিদেশী মিডিয়ায় ঝড় তোলা। বিদেশী বন্ধুদের কাছে প্রমাণ করা যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পাশাপাশি সরকারকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করার একটি গভীর পরিকল্পনা রয়েছে। তারা আরও বলেন, জাপানের ৭ জন নাগরিককে এখানে হত্যা করা হয়েছে, এখন যদি জাপান তাদের সহযোগিতার হাত তুলে নেয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য চাপ হয়ে যাবে। অন্যদিকে ইতালির ব্যবসায়ীদের হত্যার কারণে ইউরোপীয় পোশাক আমদানি কারকরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে গার্মেন্টস শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে শঙ্কা ব্যবসায়ী নেতাদের। ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, এই ঘটনায় বিদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ওই ঘটনার পর গতকাল অনেক বিদেশী ক্রেতাকে দাওয়াত করেও গুলশান-বনানীর কোন অভিজাত রেস্টুরেন্টে নেয়া যায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে পাঁচতারা হোটেলগুলোয় বসে আলোচনা করতে হয়েছে। বিদেশীদের সঙ্গে আগে যেসব বৈঠকের শিডিউল ঠিক করা ছিল সেগুলোও বাতিল করা হয়েছে। যেসব ব্যবসায়ীর বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তারাও তাদের সফরসূচী বাতিল করে দিচ্ছেন। উল্টো তাদের দেশে বা সিঙ্গাপুরে যেতে বলছেন। এতে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, এর আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা, গত বছর বিদেশী হত্যার সময়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ঘন ঘন এসব ঘটলে দেশের ইমেজ সংকট প্রকট হবে। তখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে রফতানি খাত। কেননা ক্রেতারা এখন পণ্য কেনার আগে কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধা, পণ্যের ডিজাইন, উপকরণÑ এসব সরেজমিনে দেখতে আসেন। এগুলো না দেখে তারা সাধারণত রফতানির আদেশ দিতে চান না। ফলে দেশের রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা বলেছেন, এর আগে রানাপ্লাজা ধসের পরবর্তী তিন বছরে দেশের পোশাক খাত বড় ধরনের সংকট মোকাবেলা করেছে। সেটি যখন কাটিয়ে উঠেছে তখন আবার নতুন করে এসেছে সন্ত্রাসী হামলা। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য এখনই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশে বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী দূতাবাসগুলোকে এটা আশ্বস্ত করতে হবে যে, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে ব্যাপারে সরকার সতর্ক। নিহত বিদেশীদের পরিচয় ॥ গুলশান হামলায় যে ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে এদের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশী নাগরিক। এসব নাগরিকদের পরিচয় প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। ইতালির নিহত নাগরিকরা হলেন- বারিধারাভিত্তিক ইতালীয় বায়িং হাউস স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাদিয়া বেনেদিত্তো, গুলশান ২ নম্বরের আরেক ইতালীয় বায়িং হাউস ডেকাওয়ার্ল্ডের প্রাইভেট লিমিটেডের এমডি ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিস্টিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট। অপরদিকে নিহত সাত জাপানি হলেন- তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। নিহত জাপানি নাগরিকদের ৬ জন ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নিহত ভারতীয় নাগরিক হলেন তারিশা জেইন। রাজনৈতিক নেতাদের মতে, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে যখন সরকার সক্ষম হয়েছে, তখন পুরোহিত, সেবায়েত ও পাদ্রি টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। এটাও যখন সরকার শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছে তখন টার্গেট করা হয়েছে বিদেশী নাগরিকদের। যেন সরকারের সঙ্গে এসব বন্ধু রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক নষ্ট করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। ক্ষমতাসীনরা বলেন, এসব হামলার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি গ্রুপ মাঠে থেকে কাজ করছে। সরকার খুব শীঘ্রই এসবের মূল শিকর উৎপাটন বলে আশা সরকার সমর্থকদের। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, জ্বালাও-পোড়াও, পাদ্রি হত্যা, সংখ্যালঘুদের হুমকি ও সর্বশেষ বিদেশী হত্যা এসবই একইসূত্রে গাঁথা। ধর্মের আবরণে এদেশীয় ও কিছু বিদেশী শত্রু এসব ঘটনার ইন্ধনদাতা। নাসিম বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেটা কিভাবে নষ্ট করা যায়, সেই চক্রান্ত বাস্তবায়নে নেমেছে সেই চক্রটি। শীঘ্রই সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা হবে। সত্য সামনে উপস্থাপন করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সংখ্যালঘু, পাদ্রি, সেবায়েত ও সর্বশেষ বিদেশী হত্যাকা- একইসূত্রে গাঁথা। এরা একেকটি কৌশলে এগোয়, ব্যর্থ হলে আরেক কৌশল গ্রহণ করে। তিনি বলেন, এখানে দেশী-বিদেশী শত্রুর ইন্ধন রয়েছে। রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদী এ বিষয়ে জানান, রানা প্লাজার পর ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ তিন বছর লেগেছে। নতুন ঘটনা আবার ইমেজ সংকটে ফেলবে। তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশী ক্রেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। ফলে তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। বর্তমান অবস্থার কারণে এমন পরিস্থিতি আবার তৈরি হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী। পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এর প্রভাব এখই বলা যাবে না। তবে এর ফলে কিছুটা হলেও ক্রেতারা শঙ্কিত। তাই এ রকম ঘটনা আর যাতে না ঘটে সে দিকে লক্ষ রাখার অনুরোধ করেন তিনি।
×