ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজিম উদ্দিন

মাউন্ট এটনা

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১ জুলাই ২০১৬

মাউন্ট এটনা

অসি প্রাসাদের ভিতর একটি মিউজিয়াম আছে যা পাথর দিয়ে তৈরি। তবে তা কৃত্রিম কিনা প্রাকৃতিক তা জানা নেই। দুর্ভাগ্য হলো এই মিউজিয়ামের সব দেয়ালে লেখা কিছু তারিখ মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অধিকাংশ তারিখ ইতালিয়ান ভাষায় লেখা। এখানে বসার একটি জায়গাও আছে। আরেকটি কক্ষে পুরো সিসিলির ম্যাপ ৩ফ আকারে তৈরি করা। বিভিন্ন প্রকৃতিক পাথরের বর্ণনাও এতে লেখা। কোন পাথর কত সালে তৈরি। তথ্য প্রায় সবটা পাথরেই দেয়া। রুমটিতে ছোট-ছোট কিছু শেলফ আছে। পাথরগুলো সেই সেলফেই রাখা। আর কিছু পাথর চোখে পড়ল যা কিনা সেলফের বাইরে। আরেকটি চমৎকার বিষয় নজরে আসলো। উপরে দুটো সেলফের তাকে দুটো ভাস্কর্য চোখে পড়ল। বানরের ভাস্কর্য দুটো বেশ নিপুণ হাতে তৈরি করা। আমি, ফারহানা ও আমার মেয়ে নোহা এসেছি এই প্রাসাদ দেখতে। প্রাসদে রয়েছে পাথরের তৈরি অসংখ্য আদিম অস্ত্র। আছে একটি তালচিত্র। যেখানে আদিম মানুষের গ্রাম থেকে উঠে আসার গল্প রয়েছে। মাউন্ট এটনা আজ সকালের আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার। হোটেলের তিনতলার রেস্তরাঁয় বসে ব্রেকফাস্ট সারছি। হোটেলের এক-একটি জানালায় ভিন্ন রকম কিছু দৃশ্য। সামনের জানালায় সমুদ্রের নীল পৃথিবী। অন্য পাশে পৃথিবীর অন্যতম জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এটনা। ইতালির তিনটি এক্টিভ ভলকনের মধ্যে এটি অন্যতম। পৃথিবীর সুউচ্চ আগ্নেয়গিরির মধ্যে যা দীর্ঘতম। প্রায় ১০৯২২ অর্থাৎ ১১ হাজার ফুট উঁচু এ আগ্নেয়গিরি। জানালার খোলা জায়গার পুরোটায় ঠাঁই করে নিয়েছে ‘এটনা’। মাউন্টের পুরো অঞ্চলটা প্রায় ৪৬০ স্কয়ার মাইল। এ মাউন্টের উপরিভাগটা ভলকেনো। এক্টিভ ভলকেনো হওয়ার কারণে এ আগ্নেয়গিরিতে লাভা দেখা যায়। সেই লাভা কেবল ক্ষুদ্র পরিসরেই হয় না। বরং এ আগ্নেয়গিরির কারণে শহর কাটানিয়া বেশ কবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শেষে ১৬ শতকে এ আগ্নেয়গিরি হতে বিপুল পরিমাণ লাভা নির্গত হয়েছিল। তবে এখনও থেমে নেই। অল্প-স্বল্প লাভা এখনও আগ্নেয়গিরির মুখ গলে বেরিয়ে আসে পাহারের পাদদেশে। এক্টিভ ভলকেনো হওয়ার দরুন এ এলাকার জমি খুব উর্বর হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো মাউন্ট এটনাকে বিশ্ব হেরিটেজের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। আজ আমরা মাউন্ট এটনা যাব। গাড়ি নিয়ে রওনা হব। পুরোটা পথ গাড়ি নিয়ে পাড়ি দেয়া সম্ভব না। তাই বাকিটা পথ ক্যাবল কার ও বাস ভরসা। প্রায় ৪২ কি: মি: দূরের পথ। ক্যাটানিয়া শহরটা বেশ সাজানো। সমুদ্র ও পাহারের মিশেল এক অপরূপ শোভার উন্মেষ ঘটিয়েছে। ক্যাটানিয়া শহর ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। পথের দুদিকে কেবল পাহাড়। চারদিকে গাছ-পালা ছড়িয়ে আছে। আমরা আঁকাবাঁকা পথে এগোচ্ছি। সমুদ্রপৃষ্ট হতে প্রায় ৬০০০ ফিট উপরে গাড়ি চলার পথ শেষ হয়। এরপর ক্যাবলকারে পাহারের চূড়ায় উঠতে হবে। যাই হোক, আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। দূরের সাগর, অবিরত বাতাস এক মনোরম আবহের সৃষ্টি করেছে। নামার পর একটু দিশেহারা অবস্থা। কোন্ দিকটায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে তা বোঝা যাচ্ছে না। ইতালির পথনির্দেশনা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ের নয়। এ কারণে একজন আগন্তুকের তার গন্তব্য সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকে না। প্রথমে ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করলাম পরে বুঝতে পারলাম এ পথটায় শেষ নয়। ক্যাবলকার পৌঁছাতে আমাদের আরও খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আবারও গাড়ি স্টার্ট দিলাম। অবশেষে পৌঁছলাম ক্যাবলকারের স্থানটিতে। যাওয়ার পর ক্যাবলকারের টিকেট সংগ্রহের পালা। আমার মেয়ে নোহা ছয় বছরের কম হওয়ার কারণে তার জন্য টিকেট নিতে হয়নি। অন্যদের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫৪ ইউরো। প্রতিটি কেবল কারে ছয়টি আসন। ক্যাবলকারের যাত্রাটি খুব দীর্ঘ নয়। মাত্র ১০ মিনিটেই ক্যাবলকার আমাদের পাহারের কিছুটা উপরে পৌঁছে দিল। ক্যাবলকার থেকে নেমেই গাছ-পালা খেয়াল করতে লাগলাম। পাহারের উপরে বাস দেখে কিছুটা বিস্মিত হতে হয়। এখানে কিভাবে বাস এলো! পরে একটি মাটির পিচ্ছিল পথ চোখে পড়ল। এ পথ দিয়েই বাসগুলো আনা হয়েছে। বাসে ওঠার জন্য তৈরি হলাম। বাসে ওঠার ক্ষেত্রেও একই দশা। কোন দিকনির্দেশনা নেই। লোকদের ভিড় দেখেই বুঝতে পারলাম, বাসে ওঠার জন্য ইলেকট্রিক কাউন্টিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫৪ ইউরোর সেই টিকেটের ছোঁয়া পেলেই কেবল কাউন্টারের স্টিকটি উপরে উঠে যায়। বাসে উঠে বুঝলাম এটা আসলে বাস নয় বরং একটি ট্রাক। মার্সিডিজ ট্রাককে বাসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। খুবই শক্তিশালী ইঞ্জিনের একটি ট্রাক। যা বাসের আদলে তৈরি করা। কালো ছাইর কারণে মাউন্টেনের চারদিকে কালো রঙে ছেয়ে যাওয়া। কোন ঘাস নেই, গাছ নেই। সবুজের দেখা নেই। এ কারণে কিছুটা মলিন দেখাচ্ছিল পরিবেশ। বাসে উঠে বসলাম, গাড়ি হেলে দুলে স্টার্ট দিল। ইতালীয় মিউজিকের শব্দ কানে বাজছে। আকাশটা বেশ স্বচ্ছ। দুটো বিশাল আকৃতির পাহাড় চোখে পড়ল। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি শুনে, এ পাহাড় নাকি ২০০২ সালে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত প্রকৃতি এই অঞ্চলে নিজের আকৃতি পাল্টাচ্ছে। ঐ দুটো পাহাড়কে ডিঙ্গিয়ে মূল পাহাড়টির অবস্থান। উঁচু দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ে যাওয়ার পথে মেঘেদের খেলা দেখতে পেলাম। যেন আচ্ছন্ন করে এ পাহাড়ে আসার জন্য স্বাগতম জানাচ্ছে। যাওয়ার পথে এমন মেঘের দিন বেশ কবার আমাদের বাসটিকে ছুঁয়ে যায়। আবার পরিষ্কার হয় পথ। সুইজারল্যান্ডের মনট্রেক্স ও ইন্ডিয়ার অটিতে এমন মেঘের খেলা দেখেছি। এ নিয়ে তৃতীয়বার মেঘের এমন আলিঙ্গন দেখলাম। কিছুটা সময় দৃষ্টি থেকে মাউন্ট এটনাকে কেড়ে নেয় দুষ্ট মেঘের দল।
×