ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

এখনও শূন্যে গদা ঘোরাতে চান তারা!

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৯ জুন ২০১৬

এখনও শূন্যে গদা ঘোরাতে চান তারা!

টেলিভিশনের টক শো এখন খুবই আলোচিত অনুষ্ঠান। সেদিন এক টক শোতে কড়া বিএনপিপন্থী একজন সুপরিচিত সিনিয়র সাংবাদিক বললেন, জঙ্গী কারা সেটা নাকি দেশের মানুষ জানে না এবং জঙ্গী দমনের নামে সরকার নাকি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলে পুরছেন। বিরোধী দলের ব্যাখ্যায় তিনি বিএনপির কথা বললেও জামায়াতের নাম এ যাত্রায় উচ্চারণ করলেন না, যদিও বছরখানেক আগেও জামায়াতের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় অন্যতম একজন সেনানী হিসেবে তাকে দেখা গেছে। তিনি আরও বললেন, সন্ত্রাসে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে তার কারণ নাকি দেশে গণতন্ত্র নেই। এই কথাগুলো যারা বলছেন তারা জেগে ঘুমাচ্ছেন, আর নয়ত কোন অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দেখেও সব কিছু না দেখার ভান করছেন। এ ধান্দাবাজদের অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণীত কথার মাধ্যমে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয় তার জন্য জঙ্গী কারা তা চিনবার জন্য দুয়েকটি পুরনো ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরছি। এক. ২০০৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস এ তাহের। নিম্ন আদালত ২০০৮ সালের রায়ে চারজনকেই মৃত্যুদ- প্রদান করে, যারা সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। হাইকোর্ট দু’জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখে, যার মধ্যে রয়েছে একই বিভাগের শিক্ষক জামায়াত নেতা মিয়া মহিউদ্দিন। কথিত আছে, তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের হস্তক্ষেপে ওই হত্যাকা-ের অন্যতম অভিযুক্ত ছাত্রশিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীকে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়া হয়। দুই. ২০১০ সালে গ্রেফতার হন জঙ্গী সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রধান মাওলানা সাঈদুর রহমান। তিনি এখনও জেলে আছেন। গ্রেফতারের সময় তার আস্তানায় যেসব কাগজ ও দলিলপত্র পাওয়া যায়, যা টেলিভিশনের ক্যামেরার বদৌলতে মানুষ সরাসরি দেখেছে, তাতে দেখা যায় সাঈদুর রহমান জেএমবি প্রধান হওয়ার আগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। জামায়াতের সিদ্ধান্তেই তিনি জেএমবির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিন. ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে জামায়াতের আফগান জঙ্গী কানেকশনের সচিত্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘জামায়াতের আফগান কানেকশন’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে জামায়াতের অন্যতম নেতা ও তখনকার সাংসদ মাওলানা আবদুস সোবহানের সঙ্গে আফগান জঙ্গী মুজাহিদ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমোতিয়ারের একটি রঙিন ছবি ছাপা হয়। পাকিস্তানের পেশোয়ারের কোন এক স্থানে মাওলানা সোবহানের সঙ্গে হেকমোতিয়ারের বৈঠক হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০০৫ সালের ৭ নবেম্বর ডেইলি স্টারের একটা প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ ১৯৯৮ সালের ২ মার্চ জামায়াত-বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক ইসলামী ঐক্যজোট নেতা এখন প্রয়াত শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হকের নেতৃত্বে ৯ জনের একটি দল আফগানিস্তানে যান সেখানকার হরকত-উল-জিহাদের আমন্ত্রণে। ওই দলে কিশোরগঞ্জের বিএনপি নেতা এক সময়ের সাংসদ মাওলানা আতাউর রহমান খানও ছিলেন। চার. ২০১৩ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় স্থানীয়ভাবে বোমা হামলা ও গ্রেনেড তৈরির কারখানায় ভয়ানক এক বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে বেশ কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্র হতাহত হন। এই মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা ইজহারুল ইসলাম হেফাজতের নায়েবে আমির এবং একই সঙ্গে আরও দুটি রজনৈতিক সংগঠন ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ ও খেলাফত মজলিশেরও চেয়ারম্যান। শেষোক্ত দুটি রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রেফতারের সময় ইজহারুল ইসলাম পুলিশকে নাকি এই বলে সতর্ক করেন যে, তিনি ২০ দলীয় জোটের নেতা, তাই তার সঙ্গে যেন বুঝেশুনে আচরণ করা হয়। সুতরাং এক থেকে চার নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত ঘটনা মিডিয়ার বদৌলতে সকলের জানা থাকা সত্ত্বেও যখন কেউ বলে জঙ্গী কারা তা কেউ জানে না, তখন নিশ্চয়ই বুঝতে হবে তারা নানা অজুহাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে প্রকৃত জঙ্গীদের আড়াল করতে চান, যেমনটা ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত সরকার করেছে। গ্রেফতারের সময় মাওলানা ইজহার কর্তৃক পুলিশকে তার অবস্থান সম্পর্কে হুঁশিয়ারি প্রদানের মধ্য দিয়ে আরেকটি বাস্তবতা বের হয়ে আসে, তা হলো বড় খুঁটি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে এরা সকলে জঙ্গী ও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর কাজে বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বিএনপি ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, এখন নাকি গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌলিক দর্শন গণতন্ত্র। সুতরাং গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। তবে সেই সময়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবস্থা, অথবা বিগত সময়ের চাইতে তুলনামূলকভাবে কতটুকু কম-বেশি আছে তা নিয়ে বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে যখন বলা হয়, গণতন্ত্রের ঘাটতির জন্যই এখন জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে, তখন ধরে নিতে হবে জামায়াত-বিএনপির ২০০১-২০০৬ মেয়াদে তাদের মতে এখনকার চাইতে বেশি গণতান্ত্রিক ছিল। তাই সেই আমলের কয়েকটি জঙ্গী তৎপরতার উদাহরণ তুলে ধরছি। এক. ২০০৫ সালের তিন অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম জেনারেশনের জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) একযোগে একই সময়ে দুপুর ১২টায় গ্রেনেড ও বোমা হামলা চালায় চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলা আদালত প্রাঙ্গণের ভেতরে। তাতে প্রায় ডজনখানেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। দুই. ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠি আদালত প্রাঙ্গণে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় বিচারক জগন্নাথ পাড় ও সোহেল চৌধুরীকে। তিন. ২০০৫ সালের ২৯ নবেম্বর গাজীপুর আইনজীবী সমিতি ভবনে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সমিতির সাবেক সভাপতিসহ ৯ জন, আহত হয় অনেকে। চার. ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তিন, আহত প্রায় ৭০ জন। তবে ভাগ্যক্রমে অল্পতে বেঁচে যান আনোয়ার চৌধুরী। পাঁচ. ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে কয়েক শ’ পুলিশের উপস্থিতিতে জঙ্গীরা সমাবেশ মঞ্চের কাছে এসে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তাতে ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নিহত হন। লক্ষণীয় হলো, বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে জঙ্গীরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নিরাপদে চলে যায়। পুলিশ জঙ্গীদের ধরার চেষ্টা না করে আহত-নিহত জনগণের দিকে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেডের ওপর লেখা ছিল পিওএফ, অর্থাৎ পাকিস্তান অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি। ধারণা করা হয় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে পাচার হওয়ার পথে চট্টগ্রামে ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল যে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে তার সঙ্গে থাকা গ্রেনেড থেকে যে কোনভাবেই হোক ওই গ্রেনেড জঙ্গীদের কাছে চলে যায়। ছয়. ২০০৪ সালে জেএমবি ও জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ) নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই রাজশাহীর বাগমারায় নিজস্ব ইসলামিক শাসন চালু করে। ২৩ জন বিরুদ্ধবাদী মানুষকে বাংলাভাইয়ের লোকেরা হত্যা করে। জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য একজনের মৃতদেহ দিনের বেলায় উল্টো করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। এহেন বাংলাভাই ট্রাক-বাস মিছিল করে রাজশাহী শহরে যান এবং রাজশাহীর তৎকালীন পুলিশ সুপার মাসুদ তাদের অভ্যর্থনা জানান। সমস্ত ঘটনা ও পুলিশ সুপারের কীর্তি সব পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এর পরেও পুলিশ সুপার মাসুদের বিরুদ্ধে তখনকার সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রতিটি ঘটনার পর তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের ভাষ্য ছিলÑ জঙ্গী বলে কিছু নেই, এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বর্ণিত পুরনো ঘটনাগুলো সকলের জানা থাকা সত্ত্বেও আজ আবার তুলে ধরলাম এ কারণে যে, আজকে যারা বলছেন গণতন্ত্রের ঘাটতির কারণে জঙ্গী হামলা হচ্ছে, তাতে প্রমাণ হয় তাদের শাসনামল আজকের চাইতেও ভয়ঙ্কর অগণতান্ত্রিক ছিল, আর নয়ত তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত সত্যকে লুকাবার চেষ্টা করছেন। ২০০৪-২০০৫ সালে জঙ্গীরা যে সক্ষমতা দেখিয়েছে, যার কিছু বর্ণনা আজকের লেখার মধ্যে উল্লেখ করলাম, সে রকম বড় আকারের ও পুলিশের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঢুকে ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আর করতে পারেনি। পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছে সফট বা সহজ নিরাপদ টার্গেট। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-খ্রীস্টানসহ কিছু বাঙালী সংস্কৃতমনা মানুষকে বেছে বেছে হত্যা করছে, যারা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ নিরীহ ও নিরপরাধ। এসব হত্যাকা-ের ইমিডিয়েট লক্ষ্য সরকারকে সঙ্কটে ফেলা, দুর্বল করা এবং পশ্চিমা বিশ্বের চাপে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- রহিত করার চেষ্টা। সুতরাং জঙ্গী কারা, তাদের লক্ষ্য কী সেটা আজ দিনের মতো পরিষ্কার। তার পরেও আসল টার্গেট- শত্রু বাদ দিয়ে নানা অজুহাতে যারা শূন্যে গদা ঘোরাতে চান তাদের দুরভিসন্ধি দেশের মানুষকে বুঝতে হবে। জঙ্গী ও শূন্যে গদা ঘোরানো পার্টি, এদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। এরা সকলেই অপশক্তি। তাই নিত্যরঞ্জন পা-ে বা অধ্যাপক রেজাউল করিমের মতো নিরীহ মানুষের রক্তক্ষরণ ঠেকাতে দেশের মানুষকে সচেতন এবং সজাগ হয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অলিতে গলিতে, গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, বাজার-মার্কেটে সুসংগঠিত জঙ্গী প্রতিরোধ কমিটি করে সর্বত্র নিরাপত্তার একটি প্রাথমিক বলয় সৃষ্টি করতে হবে। তার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় ও সংযোগ হলে বর্বর হত্যাকা- চালিয়ে দুর্বৃত্ত-জঙ্গীরা সহজে পার পাবে না। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×