ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ১৪ জুন ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

গত মঙ্গলবারে রমজান শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ অতিক্রম করে এলাম। রোজার মাসে ঢাকার দিন ও রাতে কিছু বড় পরিবর্তন আমাদের নজরে আসে। অফিসের সময়সূচীতে পরিবর্তন আসে বলে নাগরিক জীবনধারা কিছুটা বদলে যায়। সরকারী, বেসরকারী চাকরিজীবী, অন্যান্য পেশাজীবী, ছাত্র-বেকার সবার মধ্যে একটা তাড়না থাকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ইফতারি করার। ফলে সন্ধ্যার আগের তিনটে ঘণ্টা ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের ওপর চাপ বেড়ে যায়। চলমান যানবাহনের ভেতর যত যাত্রী অবস্থান করে সে সময়টাতে, তার চেয়ে বরং বেশি মানুষ থাকে যানবাহনে ওঠার প্রতীক্ষায় রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাস্তা ভর্তি যানবাহন, রাস্তার দুই পাশে, ফুটপাথে এমনকি রাস্তার ভেতরে খালি জায়গায় মানুষ গিজগিজ করতে থাকে। বেশ কিছু পাবলিক বাস এই সময় নগরীর অতিভিড়াক্রান্ত কয়েকটি এলাকার বাস স্টপেজে রাখা হলে কিছু চাপ যে কমে, তাতে সন্দেহ নেই। গত বছর ফার্মগেটে কয়েকটি ডবল ডেকার রাখা হয়েছিল অফিস ছুটির পর যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে। এ বছর শুধু ফার্মগেটে নয়, আরও কয়েকটি জায়গায় যাত্রীসুবিধার কথা ভেবে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা নেয়া হবেÑ ঢাকার বাসযাত্রীরা এমনটা ভাবতেই পারেন। এখনও পর্যন্ত এমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কর্তৃপক্ষ অতীত থেকে আর কী শিক্ষা নিলেন? আরেকটা বিষয় অস্বীকারের উপায় নেই যে রমজানে বাড়তি রোজগারের জন্য হোক, কিংবা কেনাকাটা ও বেড়ানোর জন্য হোক ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে যায়। এমনিতেই ঢাকা পরিণত হয়েছে জটিল জনারণ্যে। তার ওপর এই বড়তি চাপ কিছুতেই নিতে পারে না নগরটি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। রাজপথ বেহাল দশায় পতিত হয়। রমজানে জনকল্যাণ রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন এখন প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। অনেক বিত্তবান ব্যক্তি এবং সামাজিক সংগঠন দুস্থদের জন্য ইফতারির আয়োজন করে থাকে। তবে দুস্থ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের কথা তেমন শোনা যায় না। এবার তার ব্যতিক্রমই বলতে হবে। রোজার শুরুতেই পুরনো ঢাকার নাজিরাবাজার বাংলা দুয়ার পঞ্চায়েত কমিটি তিন শ’ দুস্থ পরিবারের মাঝে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী বণ্টন করেছে। মানুষ মানুষের জন্য। ইফতার ও ঈদের কেনাকাটায় অনেক অপচয়ও হয়। কৃচ্ছ্রতা সাধনের কথা বলছি না, অন্তত অপচয় হ্রাস করা যে দরকার, সেটা বলা চাই। ঢাকার প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের জনকল্যাণমূলক সামাজিক উদ্যোগ নেয়া হোক- এই আহ্বান জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দু’তিন জন ছাত্র উদ্যোগটি নিলেই তাতে ধীরে ধীরে লোকবল বাড়বে। একবার এই নিয়ম চালু করা গেলে প্রতিটি রমজানেই তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন কিছু হবে না। এজন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। আলিয়ঁসে আর্ট ফটো প্রদর্শনী আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে মাঝেমধ্যে যাওয়া পড়ে। ওখানকার ক্যাফের আড্ডা কখনও কখনও বেশ জমে ওঠে। তবে আমার নজর থাকে নিচতলার প্রশস্ত কক্ষটির দিকে। প্রায়ই সেখানে কোন না কোন প্রদর্শনী চলে। কখনও চিত্রকলা কখনও আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। পাশের একচিলতে করিডরেও সেই প্রদর্শনী ছড়িয়ে পড়ে। দূরের একটা সাদাকালো ছবিতে চোখ আটকে গেল। অপুষ্টিতে ভোগা এক মা ইট বহনের কাজ করতে যাওয়ার আগে ছোট ছেলের কোলে তুলে নিচ্ছেন সন্তানকে। (ছবির নামÑ কে বলেছে মায়ের মাত্র দুটি হাত?) হয়ত কাজের এক ফাঁকে মা শিশুটির খিদে নিবৃত করেছেন। এমন দৃশ্য সত্যিকারের জীবনে দেখলে হয়ত দ্বিতীয়বার আমরা তাকাই না। এখানেই ছবির আবেদন ও আকর্ষণ। বিশেষ কিছুকে সে বিশেষভাবে অবলোকনে আহ্বান জানায়। তরুণ আলোকচিত্রী জয় কে রায় চৌধুরীর প্রথম প্রদর্শনী এটি। ‘লাইফ লাইট অ্যান্ড ক্যায়োস’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। মানুষের পাশাপাশি আবশ্যিকরূপে রয়েছে প্রকৃতির উপস্থিতি। প্রত্যেকটি ছবিই আমাদের কোন না কোন গল্প শোনায়। আবার এসেছে আষাঢ় আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে... কবিগুরুর এই গানে সেই আবহমান বাংলার বর্ষার বস্তুনিষ্ঠ রূপ প্রতিফলিত। আর এই গানটি শুনলে ভাবের বৃষ্টিতেও ভিজতে থাকি আমরা। আষাঢ় আসার আগে রাজধানী ঢাকার আকাশ কবিগুরু কথিত সেই আকাশ ছেয়ে বর্ষা আসার বিষয়টিকেই মনে পড়িয়ে দিল। আকাশ ছেয়ে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে গত সপ্তাহে একাধিক দিবস ও রাত্তিরে। না, বর্ষাবন্দনা আমাদের অভিপ্রায় নয়। বর্ষার সৌন্দর্য এই ইটপাথর সিমেন্টের শহরে কিভাবে অবলোকন বা উপভোগ করা সম্ভব! সেটা করতে হলে যেতে হবে গ্রামে। যদিও গ্রাম আর আগের মতো নেই, তবু যেটুকু আছে বর্ষা সেখানে অনেক নিবিড় ও মনকাড়া। বর্ষা এলো। বর্ষার সঙ্গে ঢাকাবাসীর একটা দুর্ভোগেরও শুরু হলো। সেটি জলাবদ্ধতা। ঢাকা শহরে মাত্র দুই ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টি হলে বহু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়া নতুন কিছু নয়। জলাবদ্ধতার অর্থ হচ্ছে চলাচলে মন্থরগতি চলে আসা। প্রধান প্রধান সড়ক আগাম বর্ষার বৃষ্টিতে তলিয়ে না গেলেও দু’পাশে অনেকটা পানি জমে যায়, ফলে চলাচলের জন্য সড়কও সঙ্কুচিত হয়ে আসে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই ঢাকায় যানজট লেগে থাকে। তার ওপর জলজট হলে সেই যানজট কতখানি অসহনীয় হয়ে ওঠে তা ঢাকাবাসী মাত্রই জানেন। সংবাদপত্রের পাতায় আবার জায়গা করে নেবে সড়কের খানাখন্দে পড়ে রিক্সা উল্টে বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে নাস্তানাবুদ হওয়া পথচারীদের ছবি। এসব দেখে কষ্টের পাশাপাশি ক্ষোভের উদ্রেক হয়। একই কথা বারবার বলতে কারই বা ভালো লাগে! তবু বলতেই হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হবে কবে? এক দু’দিনের বৃষ্টি আমাদের ইঙ্গিত দিয়েছে আগামী দিনগুলোতে কী হবে ঢাকার পানিনিষ্কাশন ও যাতায়াতের অবস্থা। নাগরিকদের একটু সতর্কতা ও সক্রিয়তা যাতে আসে এই বর্ষায় সেজন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ক’বছর আগে আমার এক নিকটাত্মীয় বৃষ্টির পানি জমে থাকা রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হন। রাস্তায় পানি জমে থাকায় বোঝার উপায় নেই কোথাও কোন গর্ত আছে কিনা। উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উল্টোদিকে রাস্তায় ছিল এক মারণ ফাঁদ, যেটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) কীর্তি। গোটা উত্তরা জুড়ে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ির পর কর্তৃপক্ষ এরকম অনেক গর্তই রেখে দিয়েছিল তাদের মহাযজ্ঞের স্মারকস্বরূপ। বৃষ্টির দিনে তিন ফুট চওড়া ছয় ফুট লম্বা এবং তিন হাত গভীর এই মারণ ফাঁদটির অস্তিত্ব চলাচলকারীদের ঘুণাক্ষরে টের পাওয়ার কথা নয়। অনেক গতিশীল গাড়িই বিকল হয়েছে এর বাহাদুরিতে। এক রিক্সার সামনের চাকা পড়ে গেল তিন ফুট চওড়া ছয় ফুট লম্বা এবং তিন হাত গভীর ওই গর্তে। গর্ত না বলে পরিখা বলাই সঙ্গত। আরোহিনী হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সেখানে। মুহূর্তের ভেতর তাঁর বাম হাত ভেঙে গেল, কনুইয়ের হাড় বিশ্রিভাবে স্থানচ্যুত হলো। কাদাপানিতে বেচারি হলেন মাখামাখি। ওই মারণ ফাঁদের পাশেই ছিল চাইনিজ রেস্তোরাঁ ও মাংসের দোকান। ওই দুর্ঘটনার পর তাদের বোধোদয় হয়। মাটি ও ইট দিয়ে ভরাট করা হয় গর্তটি, একটা বাঁশের মাথায় লাল কাপড় ঝুলিয়ে দেয়া হয় যাতে পথচারীরা আগেভাগে সতর্ক হতে পারেন। এই কাজটুকু সময়মতো করা হলে আর রিক্সারোহিনীর হাত ভাঙতো না। বাধ্য হয়েই ভাবতে হয়Ñ ঢাকাকে বলছি বটে রাজধানী, কিন্তু একে কি রাজধানী বলে? ঢাকা দেশের প্রধান শহর, প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র, দেড়-দু’কোটি মানুষের আবাস, কূটনীতিকদের বিচরণক্ষেত্র, সারাদেশের যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র। এ রকম একটি শহরে অসহনীয় নাগরিক ভোগান্তি থাকা অত্যন্ত অসমীচীন। ঢাকাকে আধুনিক গতিশীল মসৃণ জীবনের নগর হিসেবে গড়ে তোলার জোরদার প্রচেষ্টা গত দুই দশকে কি আমরা দেখেছি? অথচ এ সময়ে ঢাকা উপচে পড়ে মানুষে, ভবনে, বিচিত্র প্রতিষ্ঠানে। ঢাকার দুই মেয়রের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বর্ষা এসে পড়েছে। মানুষের ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ নিন। আগামী বর্ষায় ঢাকার খানাখন্দে পড়ে কেউ আহত হবে না, এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। ঢাকায় পুশকিন আধুনিক রুশ সাহিত্যের স্থপতি কবি আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন, যাকে রাশিয়ান প্রধান জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। আলেক্সান্দর পুশকিন প্রেম বিষয়ক কবি হিসেবেও জগদ্বিখ্যাত। সমসাময়িককালে তিনি শুধু রাশিয়ান হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতে অত্যন্ত শক্তিমান কবি হিসেবে স্বীকৃত। রুশ সাহিত্যে পুশকিনের আসনের সঙ্গে তুলনীয় ইংরেজী সাহিত্যে শেক্সপীয়ার, জার্মন সাহিত্যে গোয়টে ও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আসন। আশ্চর্য দখল ও দক্ষতা ছিল তার ভাষার ওপর। অগ্রজ সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠিত ভাষারীতির অনুসরণ না করে স্বকীয় ভাষারীতির নির্মাণ করেন তিনি। যার বৈশিষ্ট্য গতিময়তা ও আধুনিকতা। ফলে ভাষা প্রাঞ্জলতা ও গভীরতা লাভ করে। তিনি কবি, কিন্তু উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েও তিনি সার্থক। তার রচিত উপন্যাস ‘ইয়েভেজোন ওনেজিন’ রুশ কথাসাহিত্যের মাইলস্টোন। কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক ভøাদিমির নাবোকভ বলেছেন, ‘সব কটি রুশ সম্রাটের রাজত্বকাল মেলালেও পুশকিনের কবিতার একটি পঙ্ক্তিরও যোগ্য হবে না।’ মূলত কবি হলেও তিনি নাটক, গল্প, মহাকাব্য, উপন্যাসও লিখেছেন। মাত্র আটত্রিশ বছর আয়ুষ্কালে তিনি রুশ ভাষা ও সাহিত্যে একাধারে আধুনিক কাব্যভাষা, বাস্তববাদ, গদ্যকাহিনী, ট্রাজেডি, কাব্যনাট্য প্রভৃতির জনক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। পুশকিন ছিলেন রাজতন্ত্রবিরোধী। রাশিয়ান রাজতন্ত্রে জারের রাজনৈতিক পুলিশের কঠোর প্রহরায় প্রকাশনা যখন কঠিন ছিল, তখনই নিজের জনপ্রিয়তম নাটক বরিস গদুনভ রচনা করেন। পুশকিন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে সম্রাট প্রকাশ্যে কিছু করার সাহস পাননি, কিন্তু আমৃত্য তার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলেন। ‘গ্রিন ল্যাম্প অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলেন পুশকিন, যা পরে গোপন রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। সে সময় তিনি দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যা হোক পুশকিন সম্পর্কে এত কথা বলা গত সপ্তাহে এই কবির আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপনকে উপলক্ষ করেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে পুশকিনের ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। এটি রাশিয়ার উপহার। এই ঘটনার ভেতর দিয়ে বোঝা যায় রুশ সরকার নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভিনদেশী নাগরিকদের সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে কত সচেতন। আমরাও কি পারি না আমাদের কালজয়ী ক’জন শিল্পী-সাহিত্যিকের আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করে বিশ্বের কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপনের উদ্যোগ নিতে? ১২ জুন ২০১৬ [email protected]
×