ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

দ্রোহ-দাহের কাব্য

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৭ মে ২০১৬

দ্রোহ-দাহের কাব্য

মানুষ শিল্পবোধসম্পন্ন প্রাণী। এই শিল্পবোধের জাগ্রত অনুভবের হাত ধরে আদি অনুন্নত আদিম সমাজ থেকে মানুষের বর্তমান আধুনিক রূপ। শিল্প অর্থ সুন্দর, সুন্দর করে সাজানো, আর যিনি সুন্দর করে কোনো কিছু সাজান তিনি শিল্পী। সৃষ্টিকর্তার অপার সুন্দরকে জানার, বোঝার ক্ষমতা যার যত বেশি তার শিল্পসৌন্দর্যবোধ বা শিল্পবোধ তত বেশি। সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সৌন্দর্য চেতনায় নিজেদের আপ্রাণ নিয়োজিত রেখেছে। সুন্দর করে থাকতে চেয়েছে, বাঁচতে চেয়েছে। শিল্পবোধ চেতনান্বিত হবার ফলে তারা ডিঙিয়ে এসেছে গুহাশ্রিত জীবন। তারা ছবি এঁকেছে, গুহাকে সাজিয়েছে। আর তাইতো শিল্প চেতনার দিক থেকে পৃথিবীতে মানুষেরই আছে সর্বশেষ্ঠতার ইতিহাস। মুক্তমনে স্রষ্টার সৌন্দর্যের মাঝে নিজের সৌন্দর্য যিনি সৃষ্টি করেন তিনি শিল্পী। শিল্পীর উদ্দেশ্যটা অসম্পূর্ণ মনের গহীনের অপূর্ব সৃষ্টিশীল সৌন্দর্যের বহির্প্রকাশ। তাই তো আপন মনের অপূর্ণ বাসনা বাস্তবায়নের জন্য শিল্পসৌন্দর্য চর্চা করেন একজন শিল্পী। তরুণ শিল্পী পারভেজ হাসান রিগ্যানের শিল্পকর্মগুলো তেমনটাই ইঙ্গিত করে। রিগ্যান বাস্তবধর্মী শিল্পী। তার শিল্পের উপজীব্য মানবদেহ। রঙ, রেখা, পরিপ্রেক্ষিত, আলোছায়ার মায়াজাল ইত্যাদির সফল প্রয়োগের মধ্যদিয়ে আদর্শিক মানবদেহের সৌন্দর্যের রূপ নির্মাণের প্রচেষ্টা করেছেন রিগ্যান। তিনি মানবদেহের পেশীর টেনশনকে ধারণ করে গতিশীলতায় মানবীয় রূপকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তার শিল্পকর্মে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের চিত্রশৈলীর সাথে নিজস্ব আঙ্গিক যোগ করে নতুন এক শৈলী যোগ করেছেন। তার ফিগার প্রধানকাজ অবশ্য এক হিসেবে আধাবাস্তব। অনেকক্ষেত্রে তার মানুষের মাথা থাকে না বা অপ্রদর্শিত একটি হাত বা পা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ফিগারের মধ্যে আরেকটি ফিগার ভিন্ন ভঙিমায় অঙ্কিত হয়েছে। ছোট-বড় ক্যানভাসের ওপর গতিশীল ও পেশীবহুল অতিমানবীয় পুরুষের ছবি এঁকেছেন তিনি। রঙ-তুলির সাহায্যে যথাযথ উপস্থাপন, প্রতিস্থাপন ইত্যাদি বিষয় সার্থক ও সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন। তুলে ধরেছেন শারীরিক সৌন্দর্যের দ্যুতি। যেন অলৌকিক ও অসীম শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তার ফিগার নৃত্যের সংবেদনা জাগ্রত করে এবং সময়কে মহাকালের সঙ্গে একাকার করে দেয়। “ফ্রিডম অব সোলস” শিরোনামের শিল্পকর্মটি শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। চারকোল মাধ্যমে আঁকা। উপরপানে দৃষ্টি, এলোমেলো চুল, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ।সাদা ক্যানভাসে কালো চারকোলে রেখা ও আলোছায়ার মাধ্যমে মানব অস্তিত্বের ব্যাখ্যাতীত অনুভূতিকে অবলীলায় উৎকীর্ণ করে শিল্পের সঞ্জীবনী সুধা ফুটিয়ে তুলেছেন। আহ্বান জানিয়েছেন আত্মার স্বাধীনতার। শিল্পীর প্রতিটি ছবিতে রয়েছে মানুষের জীবনের কথা এবং রঙের নানা ব্যবহার। মাধ্যম হিসেবে শিল্পীর চিত্রকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে তেলরঙ, চারকোল, এ্যাক্রোলিক। তবে তেলরঙের প্রাধান্যই বেশি। রিগ্যানের কাজে আছে রহস্যময়তা। আছে বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙতুলির নিজস্ব ছাঁচে ভেঙে ফেলা প্রচলিত নিয়মকানুন। অধিকাংশ চিত্রকর্মই অর্ধনগ্ন। আর এই চিত্রকর্ম কতটা বৈচিত্র্যময় তা আর ভাবনার অবকাশ রাখে না। ‘দ্য বিউটিফুল কার্স’ সিরিজ চিত্রে মানবদেহের বিভিন্ন ভঙ্গিমা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। দেহকে এঁকেছেন একদম নিজস্ব স্টাইলে, রাখঢাকবিহীন, অকৃত্রিমভাবে। যেখানে নগ্নতার মাঝে সৌন্দর্য কতটা মোহনীয় ও সুখের হতে পারে তা অনুভব করা যায়। পেশীর ছন্দ, গতীময়তা, দেহের ভাঁজ মনোযোগসহকারে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উজ্জ্বল হলুদ আর লাল আভা ফুটে উঠেছে শরীর থেকে প্রগাঢ়ভাবে। নিজের মনের সুখ-দুঃখ শক্তিমানরূপে প্রতিফলিত হয়েছে তার আঁকায়। আনন্দ-বেদনা ধরা দিয়েছে ব্রাশের স্ট্রোকে। ‘দ্য ক্যাপটিভ সোল’ সিরিজচিত্রে আদর্শায়িত পুরুষ ফিগার অঙ্কিত হয়েছে। একটি ফিগারের কোলের ওপর আরেকটি ফিগার হাত, পা ছেড়ে দিয়ে শায়িত অবস্থায়, দুই হাত মাথার ওপর দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে বসে থাকা ফিগার। শিকলসহ রাজবল্লম হাতে মাথা নিচু করে বসে থাকা পুরুষ ফিগার দেখা যায়। ড্রাপারি বা কাপড়ের ভাঁজগুলো বেশ যতেœর সঙ্গে আঁকা হয়েছে। তার এই চিত্রগুলোতে বাস্তবানুগ বহিরাঙের সাদৃশ্যের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার মনের ভাব, তার মানসিকতা। এই ফিগারেটিভ কাজগুলোতে দেখা য়ায় তার বিভিন্ন রূপায়ব। যেন মানুষগুলো স্থান ও কালের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীন সত্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার রূপায়বের বা ফিগারগুলোতে পার্শরেখার পাশাপাশি সহায়ক একটি হালকা রেখা দেখা যায়। ফিগারেটিভ আর্টের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তার চিত্রে পরিলক্ষিত হয়। দর্শকদের চোখের সামনে সব কিছুকে সহজ-সরল এবং বাস্তবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন রিগ্যান। ‘দ্য হোমো সেপিপেন্স’ সিরিজে প্রতিকৃতি চিত্র স্থান পেয়েছে, আছে নারী ও পুরুষের প্রতিকৃতি। নারী প্রতিকৃতিগুলোর কোনটাতে আবক্ষ পর্যন্ত খালি গায়ে আঁকা হয়েছে। কোনটির মাঝখানে আছে বক্ষদেশ। কোনটির আবার মাথাসহ বক্ষদেশ উদাম। পুরুষের প্রতিকৃতিগুলোর কোনটির ব্যাকগ্রাউন্ড আঁধারে মিলে গেছে শুধু মাথাটুকু স্পষ্ট, আবার কোনটির ব্যাকগ্রাউন্ড হালকা আলোকিত, প্রতিকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন। চোখে-মুখে নানা অভিব্যক্তি। রঙের আশ্রিত আলো-আঁধারির খেলায় ভিন্নতা দেখা যায় চিত্রগুলোতে। এভাবে চিত্রে উঠে এসেছে শিল্পীর আনন্দ-বেদনার কথা। রঙের আভায় মুখশ্রীতে উদ্ভাসিত হয়েছে প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার বয়ান। রঙের পরে রঙ চাপিয়ে অবয়বের ওপর মেলে দিয়েছেন ভাবনা। রিগ্যানের চিত্রসম্ভারে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তার সময় ভাবনা,কাল-যন্ত্রণ“ পাশাপাশি উপস্থাপিত হয়েছে শিল্প দক্ষতা ও চিন্তার উৎকর্ষতা। এ যেন সময়ের দ্রোহ-দাহের কাব্য। রঙ আর রেখার ছোঁয়ায় মনের অবয়বের ভেতর থেকেই মেলে ধরেছেন নিজস্ব ভাবনাকে। চিত্র সৃজনের মধ্যে রিগ্যান এক ধরনের আধ্যাত্মিক ভ্রমণ রচনা করতে চান। চান শিল্পের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে। তাই তো আঁধার পটভূমিতে হঠাৎ কোনো অবয়বের অভিব্যক্তি বা দেহের আকুতিকে উপস্থাপনায় তিনি সাবলীল। উজ্জ্বল রঙের আলো- ছায়ায় মানবদেহের ওপর নাটকীয় আবহ, ব্রাশিং, স্ট্রোক ভীষণ স্বকীয় এবং স্পষ্ট। শিল্পীর কাজে বাস্তবতা ও অনুরাগের প্রবণতা তীব্রভাবে টের পাওয়া যায়। সম্প্রতি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে শেষ হয়ে গেল তরুণ এই শিল্পীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী ‘বিয়ন্ড দ্য হরাইজন’। তার চিত্রে শুধুমাত্র মানুষের দুঃখ-বেদনা বা সর্পিল মনের গতির বার্তা বয়ে আনে না, তার নিজের খেয়ালে সৃষ্টির অনাবিল আনন্দও নির্দেশ করে। এই শিল্পকর্মগুলোতে তার শিল্পজীবন যেন একটি বৃত্ত পরিপূর্ণ করে।
×