ছিন্নপত্রের কোন একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- বেদনাটুকু ক্ষণিক এবং বিস্মৃতিই চিরস্থায়ী। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে- এই বেদনাটুকুই বাস্তবিক সত্যি, বিস্মৃতি সত্যি নয়। এক একটা বিচ্ছেদ এবং এক একটা মৃত্যুর সময় মানুষ সহসা জানতে পারে এই ব্যথাটা কী ভয়ঙ্কর সত্যি। জানতে পারে যে, মানুষ কেবল ভ্রুমক্রমেই নিশ্চিন্ত থাকে। আশঙ্কা এবং শোকই জগতের ভিতরকার সত্য।
আজ থেকে বছর তিনেক আগে রানা প্লাজার ধস এদেশ তো বটেই সমগ্র পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছিল। হাজারো মানুষের রক্তবলিতে রঞ্জিত হয়েছিল সাভার। মানুষের হাহাকার, যন্ত্রণা, শোক কিছুই নির্বাপিত হয়নি আজও। সরকারি-বেসরকারি আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সমবেদনা শোকার্ত জীবিত মানুষগুলোর পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এতদসত্ত্বেও যাঁরা চিরতরে হারিয়ে গেছেন তাঁদের ক্ষতি তো অপূরণীয়। আর নানারকমে অসহায়ভাবে আহত হয়ে অঙ্গহানি মেনে নিয়ে যারা বেঁচে আছেন তারাও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই উঠে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে তিন নরডিক দূতাবাস ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, চিত্রশিল্পীদের সংগঠন সাঁকো, মীনা ই.ভি, আর্য চলচ্চিত্র ফাউন্ডেশন ও ফ্যাশন রেভল্যুশন। বলাইবাহুল্য এ সংগঠনগুলোর আয়োজনে রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পূর্তি ও নারী দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে উইংস অব হোপ’ শীর্ষক এক শিল্প প্রদর্শনী শুরু হয়। কর্মশালার আওতায় বেঁচে যাওয়া কর্মীগণই এই চিত্রকর্মগুলো সৃজন করেছেন। শোকাবহ রানা প্লাজার ছত্রিশ জন নারী সাঁকো আর্ট সংগঠনের শিল্পীগণের সঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় যুক্ত হয়ে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। এতে ভাস্কর্যের ব্যাকরণ করণ কৌশলগুলো নির্মাণে সহায়তা দিয়েছেন শিল্পীগণ। আর রানা প্লাজার ঘটনার শিকার নারী কর্মীগণ তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, আশা, হতাশা, দুঃসহ স্মৃতির মিশেলে সৃজন করেছেন এক একটি মিনি ভাস্কর্য। ডেনমার্কের শিক্ষক কার্স্টেন ফুগোর তত্ত্বাবধানে মোমের ভাস্কর্য তৈরির পর সেগুলোকে ধাতব ভাস্কর্যে রূপ দেয়া হয়। কালো ধাতব এই ভাস্কর্যগুলো নর ও নারীর নানারকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছে। কোনটির ভঙ্গি নৃত্যের কোন মুদ্রার আবার কোনটি সাঙ্গিতিক আবহ ফুটিয়ে তুলেছে। এছাড়া বিষয় হিসেবে আছে শৈশবের দুরন্তপনা, হাতে হাত ধরা সহযোগিতা এবং নানারকম অনুভূতিজাত বন্ধন, মনসিজ আবেগ, বন্ধুতা, সুখের আবেশে পারিবারিক আবহ, সৌন্দর্যের অবগাহন, মুখাবয়ব, পাহাড়ী সংস্কৃতি ইত্যাদি। এ প্রদর্শনীতে এককভাবে চিত্রকর্ম উপস্থাপন করেছেন নন্দিত শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা, ফারজানা ইসলাম মিল্কি, সুলেখা চৌধুরী, ফারিহা জেবা, লুতফুন নাহার লিজা, নাইমা হক, রেবেকা সুলতানা মলি, ফারজানা রহমান ববি প্রমুখ। নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে শিল্পকর্মগুলো উপস্থাপিত হয়েছে। কনক চাঁপা চাকমার একাধিক চিত্রকর্ম আছে যেখানে কাগজের কালো জমিনে সোনালি রং দিয়ে উপজাতীয় জীবনযাত্রা, প্রকৃতি, কৃষ্টি উঠে এসেছে। নিসর্গ যেন স্বর্গীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। রেবেকা সুলতানা মলির একটি ছবিতে এক্রিলিক মাধ্যমে নারীর সুসজ্জিত মুখাবয়ব অত্যন্ত নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এছাড়া ধাতব ভাস্কর্য ‘বন্ধুত্ব’ এ দেখা যায় শৈশবে হাত ধরাধরি করে ক্রীড়ারত দুটি বালক-বালিকা। চিত্রকর্মটি দেখে দর্শকগণ স্মৃতিকাতর হয়ে যার যার শৈশবে ফিরে যাবেন নিঃসন্দেহে।
প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলো থেকে বিক্রিত অর্থ রানা প্লাজার দুর্গতজনদের সহায়তায় দেয়া হবে। এই শিল্পকর্মগুলোর প্রতীকী মূল্য আর শিল্পমূল্য কোনটিই কম নয়। এতদসত্ত্বেও বহুল প্রসার এবং বিপণনের নিরিখে কিছু ভাস্কর্যর মূল্য আরেকটু কম হলে ভাল হতো বলে প্রতীয়মান। প্রদর্শনীর নামকরণেও আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। প্রচ- আশাবাদ নানারকম দৈব দুর্বিপাকের মাঝেও আবার আমাদের শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ জাতির জনগণের তীব্র প্রাণশক্তির পরিচায়ক এটি। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে আয়োজিত এই শিল্প প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন ব্রাকের চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল। ওই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্কের রাষ্টদূতগণ।
আলোচ্য প্রদর্শনীটি প্রয়াত চিত্রশিল্পী ও নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠুকে নিবেদন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি এই প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। রানা প্লাজার দুর্গতজনদের নিয়ে তিনি ‘ডেড হ্যান্ডস্ রাইজিং’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেছিলেন।