ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বারে বারে পথ দেখান

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩১ মার্চ ২০১৬

বারে বারে পথ দেখান

বর্ষীয়ান অভিনেতা উৎপল দত্তের জন্মদিন ছিল ২৯ মার্চ। তাকে নিয়ে লিখেছেন আরেক গুণী অভিনেতা দেবশংকর হালদার অভিনয় জড়িয়ে থাকা একটা বাড়িতেই আমার বড় হয়ে ওঠা। বাবা, অভয় হালদার, পেশাদার যাত্রার নামকরা অভিনেতা ছিলেন, ৩৬ বছর অভিনয় করেছেন যাত্রামঞ্চে। আমাদের জামাকাপড়, অন্নসংস্থান থেকে শুরু করে বেঁচে থাকাটাই অভিনয়ের ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। আমার যাত্রার ওপর একটা আকর্ষণ ছিলই, রোমাঞ্চে মোড়া। আবার সেই সময়কার সমাজে দাঁড়িয়ে এ-ও মনে হতো, যাত্রা জিনিসটা তেমন কেউকেটাদের করার কাজ না। তারপর, যখন বড় হচ্ছি, দু-একটা যাত্রা দেখতে গিয়ে মনে হল, বাহ্, বেশ তো! সেই সময়ই চিনলাম একজন মানুষকে, যিনি হয়তো সামগ্রিকভাবে আমার থিয়েটার-চর্চার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে নন, কিন্তু থিয়েটারের খুব প্রথিতযশা একজন ব্যক্তিত্ব। উৎপল দত্ত। তিনি এমন এক মানুষ, যিনি যাত্রা লিখছেন, আবার যাকে থিয়েটার-করিয়ে বলে জানি। আবার দেখি তিনি সিনেমায় অভিনয় করেন, ভিলেনের রোলে, কমেডি-চরিত্রেও। এমন একটা মানুষ যে প্রগাঢ় পন্ডিত হতে পারেন, নানাবিধ ভয়ংকর সব কথা বলতে পারেন, সে-ও জেনেছি পরে। তাঁর এই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনায়াস ও দাপুটে গতায়াত আমাকে এখনও স্তম্ভিত করে। আবার, কেউ যখন প্রশ্ন করে, ‘দেবশংকরবাবু, আপনি নাটক, টিভি-এ্যাংকরিং, সিনেমাÑ সব একসঙ্গে করেন কী করে?’, তখন উৎপলবাবুর মুখটা ভেসে ওঠে। ছোটবেলায় তাঁর লেখা বেশ কয়েকটা যাত্রাপালা দেখেছিলামÑ ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মাও সে তুং’। আমার চিরাচরিত যাত্রা দেখার অভ্যাসে ধাক্কা দিচ্ছিল পালাগুলো। বাবার অভিনয়-সূত্রে আমাদের যাত্রা দেখার জায়গা বরাদ্দ ছিল একেবারে কনসার্ট-বাজিয়েদের গায়ে গায়েই, মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর নিশ্বাস যেন আমাদের গায়ে পড়ত। ঠিক তেমনই, উৎপল দত্তও কাছে, খুব কাছে চলে এলেন, তাঁর পালাগুলোর মধ্য দিয়ে। ‘মাও সে তুং’-এ একটা সংলাপ ছিল: একটা স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে উঠতে পারে। আমার মনে হল, সত্যি, এ রকম কওে তো ভাবিনি! সত্তরের দশকের সেসব আগুনঝরা দিনে দেয়ালে লেখা দেখেছি ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদেও চেয়ারম্যান’, আঁকা দেখেছি মাও সে তুং-এর মুখ, কিন্তু উৎপল দত্তের নাটকেই প্রথম ওই শব্দ, ওই স্লোগান, ওই ছবির মানে বুঝলাম। জানতে ইচ্ছে হল, উৎপল দত্ত মানুষটা কে? বা, মানুষটা কতটা। কৃত্তিবাস-এর সময়কার নামকরা কবি, ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক শিবশম্ভু পাল আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনিই মাথায় ঢুকিয়েছিলেন, থিয়েটার দেখ, থিয়েটার দেখতে হয়। তখন নাইন কি টেনে পড়ি। পাঁচ-সাত টাকা পকেটে এক বন্ধুর সঙ্গে গেলাম ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। খুব বৃষ্টির সন্ধ্যা ছিল সেটা। নাটকের নাম ‘টিনের তলোয়ার’। নাটক শুরু হল। একটা লোক ময়লা তুলছিল রাস্তার নিচে ম্যানহোল থেকে, সেই ময়লা পড়ে গেছে এক বাবুর গায়ে। ‘এই তুই কে?’ ‘বাবু, আমি এই শহরের নিচে থাকা মানুষ।’ বুঝলাম, এমন একটা গল্পের মধ্যে এসে পড়েছি, এখন এই নিচের তলার মানুষগুলোর কথা হবে। তারপর তো বেণীমাধব-বেশী উৎপল দত্ত মঞ্চে এলেন, মুগ্ধ করে দিলেন একেবারে। দেখছি, খানিকটা বুঝছি, খানিকটা না, কিন্তু এটা বুঝতে পারছি, থিয়েটার নিয়েই গল্প হচ্ছে। একটা থিয়েটার-দল, তার অভিনেতাদেও বেঁচে থাকা, ছোট ছোট দুঃখ, অহংকার। পাঁচ-ছ’বার দেখেছি নাটকটা। থিয়েটারটা আমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন উৎপল দত্ত। তখনও কিন্তু চিন্তাও করিনি, এই আমিই থিয়েটারে অভিনয় করব। একটা সংলাপ ছিল, বেণীমাধব বলছে, আমি ব্রহ্মার মত, আমি অগ্নির মত, পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি। খুব মনে ধরেছিল। কী দারুণ সংলাপ! আবার একটু পরে সেই লোকটাই বলছে, আমি ভগবানের মত একা। আজ, যখন থিয়েটার ঘিরে আমার খানিকটা জীবনযাপন আর বোঝাপড়া হয়েছে, এই দুটো সংলাপ খুব মনে পড়ে। সত্যিই তো, একজন শিল্পী নিতান্ত নিজের কওে যেটুকু ভাবে, যেটুকু করে, সেই জায়গাটায় তো সে ¯্রষ্টার থেকেও বেশি! আবার, শিল্পীর ওই একা হওয়াটাকেও খুব অনুভব করি। অনেক রাতে যখন বাড়ি ফিরি, বা একটা নাটক থেকে আর একটা নাটকের শোতে যখন একা একা যাই, তখন। তখন বড় হচ্ছি, সমাজ-রাজনীতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি বটে, কিন্তু ঠিক কী যে করব, বুঝতে পারছিলাম না। এটুকু বুঝছিলাম, বামপন্থী মতাদর্শই আমাকে টানছে। যখন ছাত্র-রাজনীতিতে এলাম, অনেকগুলো নতুন প্রশ্নœ, সন্দেহ, অবিশ্বাস মাথা তুলল। মনে হল, যে কাজটা করা দরকার, সংসদীয় রাজনীতির বামপন্থা দিয়ে বোধহয় তা হওয়ার নয়। উৎপলবাবুর থিয়েটার দেখতে গিয়ে মনে হল, আরে, আমার মনে উঁকি-দেওয়া, লালন-করা কথাগুলো উনি কি নির্দ্বিধায় প্রায় ‘এ্যাজিট্প্রপ’ (এ্যাজিটেশনাল প্রপাগান্ডা) নাটকের ফর্মে বলে যাচ্ছেন! কোনও অস্বস্তি নেই! ওই সময়েই তাঁর ‘তীর’ নাটকটা পড়লাম। ভাবলাম, যে মানুষটাকে বলা হচ্ছে ‘বামফ্রন্ট সরকারের লোক’, তিনিই এই নাটকটাও লিখেছেন! ইতিহাস বেয়ে পিছিয়ে গেলাম, দেখলাম, গণনাট্য আন্দোলনের সময় তাঁকে কী রকম সন্দেহ করা হয়েছে, আর ‘তীর’ লেখার সময় তো জেলে যেতে হয়েছে! ‘তীর’ পড়ে মনে হল, আমিও তো ঠিক এই রকমই একটা লেখা লিখতে চেয়েছি! একটা ভাল লেখা পড়লে মনে হয় না এ তো আমারই লেখা? আমার মনের মধ্যের কথাগুলোই তো তিনি লিখে দিয়েছেন! ‘মানুষের অধিকার’, ‘ব্যারিকেড’ নাটকগুলো আমার রাজনৈতিক বোধকে ধাক্কা দিল। একটা অদ্ভুত মানুষকে আবিষ্কার করছিলাম, যিনি বিদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন, বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বলবেন, তার থেকে ধার করবেন, আবার পাশাপাশি একেবারে পাড়ার, রকের, আড্ডার চিন্তাভাবনা, আলাপ-আলোচনা, রাজনীতির মধ্যেও অবলীলায় ঢুকে পড়বেন। এখন বুঝতে পারি, এটাই প্রকৃত শিল্পীর কাজ। বৃহৎ, মহৎ ব্যাপারগুলো বলে যাচ্ছি আর আমার চারপাশের সংকটগুলোকে ‘লোকেট’ করতে, ‘এ্যাড্রেস’ করতে পারছি না, শুধু রূপক রূপক করে সরে সরে যাচ্ছি, এ তো পালিয়ে যাওয়া। উৎপল দত্ত কখনও পালিয়ে যাননি। আজও ‘উইংকল টুইংকল’ করার সময় আমার তাঁর কথা মনে হয়। সমসময়টাকে ধরতে পেরে যদি কথা বলতে, অভিনয় করতে না পারি, তা হলে সেটা তো ব্যর্থতা! ‘আমি এই পক্ষে আছি’ বলে তাঁর যে জানান দেয়া, সে ব্যাপারটা নিয়ে আমি এখনও দ্বিধায় থাকি। কিন্তু ওটা তাঁর যাপন ছিল। আমি নিজে যেমন এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে আমি একটা বিশেষ রাজনৈতিক মিছিলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পেরেছি থিয়েটারে। যে কোন রকম থিয়েটার করতে আমি রাজি। যে কোন রকম সময়ের সঙ্গে মেলানো থিয়েটার, যাতে আবেগ আছে, সত্য আছে। থিয়েটারের ওপর অমোঘ বিশ্বাসের সে জায়গাটায় উৎপল দত্ত আমায় পথ দেখান। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×