ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(৬ ফেব্রুয়ারির পর) মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তার এ গর্হিত মন্তব্যের জন্য তারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা সেনাসদরে অভিযোগ করেছিলেন। পরে কোর্ট অব ইনকোয়ারিতে তাকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কথাবার্তা না বলার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। মেজর ওয়াকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শ্রদ্ধেয় লে. জেনারেল (অব) মীর শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হান্নান শাহর অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত নন। অবশ্য জানলে তিনি একজন বীর মুুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হান্নান শাহকে ঘৃণা করতেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ফকির আবদুল মান্নানের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ। ফকির আবদুল মান্নান ছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার ও রাজাকারদের দোসর। স্বাধীনতার পর যেসব বাঙালি অফিসার পাকিস্তান থেকে ফেরত আসে তার মধ্যে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ একজন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে পাকিস্তানে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তার সম্পর্কে এও জানা যায়, ১৯৭৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যার চক্রান্ত করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, মেজর (অব) হাফিজ বীরবিক্রম এবং তিনি জেডফোর্স থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। জেনারেল জিয়া ছিলেন তাদের ব্রিগেড কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেজর হাফিজ এবং তার জেনারেল জিয়ার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে তা ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর কোনোদিনও থাকতে পারে না। তাই তিনি ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহকে বলবেন উনি যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করেন।” [সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ৭.১১.২০০৭] ॥ ১৫ ॥ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনের বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৫-৮১) প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। পালক পাবলিশার্স প্রকাশিত এই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৬। সাখাওয়াত হোসেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৬৬ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে আটক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় ১৬ ব্রিগেডে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পদমর্যাদা ছিল মেজর। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘটনাটি সম্পর্কে এর আগেও অনেক সামরিক অফিসার লিখেছেন। সাখাওয়াত ১৬ ব্রিগেডে থাকার কারণে কাছে থেকে ঘটনাটি দেখেছেন। জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণ ও নিহত হওয়াও দেখেছেন। মেজর সাখাওয়াতকে ১৫ তারিখ নির্দেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের যেসব ছবি তোলা হয়েছে তার নেগেটিভ নিয়ে আসার জন্য। প্রত্যক্ষদর্শীর এ বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ। মর্মস্পর্শীও। লিখেছেন তিনি- “বঙ্গবন্ধুর দেহের অবস্থা দেখে মনে হলো সামনের দিক থেকে গুলি করা হলে সাধারণত ওপর থেকে নিচের দিকে মুখথুবড়ে পড়ার কথা কিন্তু তার শরীর চিৎ অবস্থায় কেন। পরে জানতে পারলাম তিনি সিঁড়ির ওপরেই ছিলেন এবং গুলি হয়েছে ভরৎংঃ ষধহফরহম থেকে। মুখথুবড়েই পড়েছিলেন। অতিউৎসাহী অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা তার দেহকে চিৎ করে দেয় তাকে দেখার জন্য।” [পৃ. ৩৩] দুঃখ করে তিনি লিখেছেন, যে দুঃখ আমাদের অনেকেরই- “মুখমণ্ডল তেমনি শান্ত। কোথাও কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হলো মৃত্যুর ছায়াও তার মুখে পড়েনি। তার চেহারার অভিব্যক্তিতে মনে হলো তিনি তারই পরিচিত কাউকে সামনে দেখেছিলেন যাকে দেখে হয়তো তিনি বিশ্বাসও করতে পারেননি যে এদের হাতেই তাকে বরণ করতে হবে এক অবিশ্বাস্য রকমের মৃত্যু। স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি সৈনিকদের গুলির আঘাতে তাঁর জীবনের ইতি হবে এ কথা তিনি বিশ্বাস করা তো দূরের কথা কল্পনাও করেননি। তাঁর মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের গুলিতে কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের সে সাহস হয়নি। তিনি বেঁচে ছিলেন বাংলার মানুষকে স্বাধীন করে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরাই নিজের বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করার জন্য।” [পৃ. ৩৩] যে কথা আগে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল অনেক দিনের পরিকল্পনা। তার প্রমাণ পাওয়া যায় খুনি লে. কর্নেল ফারুকের কথায়। এই হৈ-হট্টগোলের মধ্যেই “সিজিএস জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তারা এ অভ্যুত্থানের আগে কি ভেবেছিল যে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? তার উত্তরে ফারুক বলেছিলেন, এ বিষয়ে তারা অনেক ভেবেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ফারুক যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলেন তেমনই ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলেন। ফারুকের চলে যাওয়ার পর সিজিএস হেসে শাফায়াত জামিলকে বললেন যে, কী [ভাবে] তিনি তাদের (অভ্যুত্থানে লিপ্ত অফিসারদের] পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের খবরটা জেনে নিলেন।” [পৃ. ৪০] একটি অভিযোগ আছে যে, রক্ষীবাহিনীর দেখাশোনা করতেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি কেন অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেন না? সাখাওয়াত হোসেনের ভাষ্যে সে রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। তোফায়েল সাখাওয়াতকে বলেছিলেন, ১৫ তারিখ ভোরে বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে ৩২ নম্বর সড়কের দিকে রওনা হয়ে মাঝপথে সাহস সঞ্চয় করতে না পারাতে এদিক-ওদিক ঘুরে রক্ষীবাহিনী সদরে পৌঁছান। রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ফোন করে জানানো হয় সকাল থেকে তোফায়েল আহমেদ বসে আছেন। তাকে নিয়ে তারা কী করবেন? “আমি সত্যিই আশ্চর্য হলাম রক্ষীবাহিনী এমনভাবে আত্মসমর্পণ করল যে, তারা জনাব তোফায়েল আহমেদকে কিছু সময়ের জন্য রাখতেও বিব্রত বোধ করছে। ...ভাবতেই অবাক লাগল যে রক্ষীবাহিনী নিয়ে প্রথমে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং পরে সমগ্র সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা করে উৎকণ্ঠিত ছিল সেই বাহিনী তাদের সদর দপ্তরে তোফায়েল আহমেদকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না।” [পৃ. ৪৩, ৪৫] আনোয়ার উল আলমের লেখায় এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে। সাখাওয়াতের সে সময়ের ধারণা সঠিক ছিল না। চলবে...
×