ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাকছে প্রাণের মেলা

বায়ান্নর রক্তে লাল ইতিহাস, ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

বায়ান্নর রক্তে লাল ইতিহাস, ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলতে পারি...। ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া সন্তানদের ভুলেনি বাংলা মা। সেই বায়ান্নর রক্তে লাল ইতিহাসটি নানাভাবে লালন করছে। এ ক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ- অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বই বিক্রি নয় শুধু, বাঙালীর নিজেকে খুঁজে নেয়ার উৎসব। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উৎসবে যোগ দেন লেখক পাঠক প্রকাশকরা। সকল অন্ধকার অশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য সুন্দরের পক্ষে বলেন। আর মাত্র কয়েকদিন। এর পরই দৃশ্যমান হবে এবারের আয়োজন। ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে প্রাণের মেলা চলবে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত। এখন চলছে জোর প্রস্তুতি। একটু পেছন থেকে বললে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ দিয়েছিল রফিক শফিক বরকত জব্বাররা। তরুণ তাজা প্রাণের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া হয় ‘আমরি বাংলা ভাষা’। ভাই হারানোর ব্যথা ও মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার গৌরব একইসঙ্গে ধারণ করে বইমেলা। ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনন্য সাধারণ আয়োজনের নাম দেয়া হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সকলেরই জানা, শুরুটা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের বটতলায় চট পেতে বসেছিলেন স্বাপ্নিক পুরুষ। মাত্র ৩২টি বই সেখানে। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। সীমিত বই নিয়ে এই প্রকাশক একাই উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৬ সালে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। এর পর অনেক বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি চত্বরে। কিন্তু পরিসর ছোট ও জনসমাগম বাড়তে থাকায় দেখা দেয় বিপত্তি। সমাধানকল্পে ২০১৪ সালে মেলা সম্প্রসারিত করা হয় ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। বিশাল পরিসর মেলা আজ সারা দুনিয়ার বাঙালীর আবেগ ভালবাসার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ। প্রতিবারের মতো এবারও আগেভাগেই আলোচনায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আয়োজনটি ঘিরে উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই। যথারীতি মেলার বাংলা একাডেমি অংশে থাকছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ১ ফেব্রুয়ারি এখানে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে প্রতিদিনই মঞ্চে থাকবে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চত্বরের অন্য অংশে নির্মাণ করা হবে স্টল। বহেরা তলায় থাকছে লিটলম্যাগ চত্বর। মূল মেলা অনুষ্ঠিত হবে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। এখান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাস যুদ্ধ শেষে একই উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী। বইমেলা সম্প্রসারণের ফলে গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী সবুজ চত্বর অমর একুশের ইতিহাসটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এবার দুই অংশের দূরত্ব আরও কমিয়ে আনা হয়েছে। বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে যেখান থেকে উদ্যানের শুরু, সেখান থেকেই স্টল বসছে। এর ফলে মাঝখানের বিচ্ছিন্নতাটুকু দূর হবে। এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের যোগাযোগও সহজ হবে। শনিবার মেলার দুই ভেন্যু ঘুরে দেখা যায়, একটু একটু করে ফুটে উঠছে মেলার চেহারা। অনেক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে পেরেক ঠুকার শব্দ। কাছে গেলে এবারের মেলার চেহারাটি অনুমান করা যায়। এবারও বর্ধমান হাউসের সামনে তৈরি হচ্ছে মেলামঞ্চ। নিরাপত্তা সৌন্দর্যসহ সব দিক বিবেচনায় রেখে চলছে নির্মাণ কাজ। অসংখ্য বাঁশ একটির সঙ্গে অন্যটি জোড়া দিয়ে কাঠামো গড়া হয়েছে। আজ কালের মধ্যে ওপরের অংশ ঢেকে দেয়া হবে তিরপালে। বাংলা একাডেমির পুরনো ভবনের সামনের অংশে দৃশ্যমান হবে মূল মঞ্চ। চত্বরের বাকি অংশে চলছে স্টল নির্মাণের কাজ। আয়োজক সূত্র জানায়, মূল মেলা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত হলেও একাডেমির ভেতরে স্টলের সংখ্যা কমছে না। বরং বেড়েছে। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও টেলিভিশন চ্যানেল নিজেদের স্টল সাজাবে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, বাংলা একাডেমি প্রান্ত থেকে স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত মেলা বিস্তৃত। উদ্যানের মুক্ত মঞ্চটিও মেলার অংশ করা হয়েছে। এখানে চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখন বিশাল এলাকার পুরোটাতেই চলছে নির্মাণ কাজ। প্রথমবারের মতো এ অংশটি গুচ্ছাকারে সাজানো হয়েছে। মোট ১৫টি গুচ্ছ। প্রতিটি গুচ্ছে একটি করে প্যাভিলিয়ন। থাকছে চার তিন ও দুই ইউনিটের স্টল। এভাবে মোট ১৫টি স্থান বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রকাশকরা নিজেদের মতো করে স্টল সাজাচ্ছেন। আদর্শ প্রকাশনীর প্রকাশক মামুন অর রশিদ জনকণ্ঠকে বলেন, শনিবার সকাল থেকে স্টল সাজানোর কাজ শুরু করেছি আমরা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব। সেভাবেই কাজ করছি। এখন পর্যন্ত কোন সমস্যার মুখোমুখি হননি বলে জানান তিনি। ইত্যাদি প্রকাশের স্বত্বাধিকারী জুয়েল বলেন, গুচ্ছ আকারে সাজানো মেলা পাঠক পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সহায়তা করবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সর্বশেষ জানতে চাইলে সদস্য সচিব জালাল ফিরোজ জনকণ্ঠকে বলেন, সব দিক মাথায় রেখেই প্রস্তুতি চলেছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। বরং মেলা সফল করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
×