ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫

পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে অবশেষে স্বাক্ষরিত হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিপত্র। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দুটি কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে চুক্তিটি। রূপপুরে কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য রাশিয়ার রোসাতোমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটমস্ত্রয়েক্সপোর্তের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান নিজ নিজ সরকারের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। এর আওতায় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট স্থাপন করা হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, যা টাকার অঙ্কে এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা। নির্মাণের ৭ বছরের মাথায় কেন্দ্রটিতে বিদ্যুত উৎপাদনের কথা রয়েছে। প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে যাবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে বিদ্যুত উৎপাদন করবে দ্বিতীয় ইউনিটটি। উৎপাদন অব্যাহত থাকবে একটানা ৫০ বছর। বিনিয়োগের ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের মধ্যে রাশিয়া ঋণ হিসেবে দেবে ১১৩৮ দশমিক ৫ কোটি ডলার এবং বাকিটা বহন করবে বাংলাদেশ। ঋণের সুদ ধার্য করা হয়েছে লন্ডন আন্তঃব্যাংক সুদের হারের ওপর ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগামী বছরের মার্চে স্বাক্ষরিত হতে পারে ঋণ চুক্তিটি। এই কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হিসাব করা হয়েছে তিন টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের ওপর সবিশেষ জোর দেয়। এর অবশ্য কারণও আছে। বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডাই হলো দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও শিল্পোৎপাদনে জ্বালানি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, সরকার এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছে। বর্তমানে তেল ও গ্যাসনির্ভর বেশ কিছুসংখ্যক বিদ্যুত কেন্দ্র চালু রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ২২০০-২৪০০ মেগাওয়াট। সুদূর গ্রাম-গঞ্জেও বর্তমানে বিদ্যুতের লাইন পৌঁছে গেছে এবং লোডশেডিংয়ের উৎপাত বলতে গেলে অনুপস্থিত। তবে এতেও আত্মপ্রসাদের কোন অবকাশ নেই। বর্তমানে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে অর্থনীতিকে উন্নীত করতে হলে আমাদের আরও অনেকদূর যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আরও বেশি বড় ও ভারি শিল্প কলকারখানা স্থাপন এবং তার জন্য অব্যাহত বিদ্যুতপ্রবাহ। সেক্ষেত্রে পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পারমাণবিক বিদ্যুত ব্যবহার করাই শ্রেয়। প্রথম পর্যায়ে এটি স্থাপনে ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি বলে মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি সাশ্রয়ী, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। তাই বলে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে ঝুঁকি নেই, এমন কথাও বলা যাবে না। দেশে-বিদেশে এ নিয়ে বিতর্ক আছে ও থাকবে। বিশেষ করে রাশিয়ার চেরনোবিল এবং জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনাসহ ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদহানির পর এই বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে। তদুপরি মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল এবং কৃষিপ্রধান। আর তাই রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর। আর এর জন্য কেন্দ্রটি সর্বক্ষণিক নজরদারি, দেখভাল ও পরিচালনার জন্য দেশেই গড়ে তুলতে হবে একনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক, কর্তব্যপরায়ণ সর্বোপরি নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ জনশক্তি। রাশিয়া এবং রোসাতোম এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলেই প্রত্যাশা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রটি বিনিয়োগের দিক থেকে দেশের এক নম্বর বড় প্রকল্প। এর পাশাপাশি উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্র্রযুক্তিনির্ভর তো বটেই। চুক্তির আওতায় প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুত উৎপাদন সর্বোপরি ওয়ারেন্টি সময়কালে মেরামত-সংরক্ষণ- এ সবই করবে রোসাতোম। এর পাশাপাশি বাংলাদেশী বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও কর্মীবাহিনী। আর এর মাধমেই দেশে গড়ে উঠবে কার্যকর দক্ষ জনশক্তি। আমরা এই প্রকল্পের সাফল্য কামনা করি।
×