ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাসান আবদুল কাইয়ূম

‘শাহ আস্ত হুসাইন/ পাদশাহ আস্ত হুসাইন/দীন আস্ত হুসাইন/ দীনে পানাহ আস্ত হুসাইন’

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

‘শাহ আস্ত হুসাইন/ পাদশাহ আস্ত হুসাইন/দীন আস্ত হুসাইন/ দীনে পানাহ আস্ত হুসাইন’

হযরত ইমাম হুসাইন রাদি আল্লাহ তা’আলা আনহুর আম্মাজানের নাম হযরত ফাতিমাতুয যাহরা রাদিআল্লাহ তাআলা আনহা এবং আব্বাজানের নাম হযরত আলী মুরতাযা করমাল্লাহু ওয়াজহাহু আর নানাজান হচ্ছেন সরকারে দো আলম নূরে মুজাসসম সাইয়েদুল মুরসালিন খাতুমুন্নাবীয়ীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। হযরত ইমাম হুসাইনের মর্যাদা যে কত সুমহান তা বলে শেষ করা যায় না। গরিবে নওয়াজ সুলাতানুল হিন্দ সুলতানুল আরেফীন খাজা মঈনুদ্দীন হাসান সঞ্জরী আজমেরী চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর কাব্য কর্মের এক জায়গায় বলেন, শাহ আসত হুসাইন বাদশাহ আসত হুসাইন দীন আসত হুসাইন ও দীনে পানাহ আসত হুসাইনÑ হুসাইন হচ্ছেন সম্রাট, হুসাইন হচ্ছেন বাদশাহ/দীন হচ্ছেন হুসাইন এবং দীনের আশ্রয়ও হুসাইন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর কন্যা ফাতিমাতুয যাহরা রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহাকে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর ২৪ রমাদান শুক্রবার হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহুর সঙ্গে বিয়ে দেন। তারপরের বছর অর্থাৎ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, যাঁর নাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রাখেন হাসান। আর ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে আর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, তাঁর নাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রাখেন হুসাইন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হাসান-হুসাইন-এই দুই নাতিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি হুসাইন রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু সম্পর্কে বলেছেন : হুসাইনু মিন্নী ওয়া আনা মিন হুসাইন, আহাব্বা আল্লাহু মান আহাব্বা হুসাইনা-হুসাইন আমার থেকে আর আমি হুসাইন থেকে, হুসাইনকে যে ভালবাসবে আল্লাহ তাকে ভালবাসবেন। (তিরমিযী শরীফ)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের চেহারার সঙ্গে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা আলা আনহুর চেহারার দারুণ মিল ছিল। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু তা আলা আনহু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, লাম ইয়কুন আহাদুম মিনহুম আশবাহু বিরসুলিল্লাহি মিনাল হুসাইনবনি আলী আহলে বায়তের মধ্যে হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-অপেক্ষা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের অধিক সদৃশ আর কেউ নেই। (তিরমিযী শরীফ)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে, একদিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হুসাইনকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটছিলেন। এক ব্যক্তি তা দেখে হুসাইনকে বললেন : খোকা। তুমি কত উত্তম বাহনে আরোহণ করেছ! এ কথা শুনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন আর আরোহীটাও তো কত উত্তম। (তিরমিযী শরীফ)। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহুর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর নানাজান সরকারে দো আলম নূরে মুজাসসম খাতামান্নাবীয়ীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর রফীকুল আলা আল্লাহ জাল্লা শানহুর একান্ত সান্নিধ্যে গিয়ে মিলিত হন আর তাঁর আম্মাজান খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাতুয যাহরা রাদিআল্লাহ তাআলা আনহা যখন চলে যান তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে ছয় বছর। শৈশবে তিনি নানা জানের সান্নিধ্যে বেশিরভাগ সময় থেকেছেন এবং ইলম, আমল, আখলাক গড়ে তুলেছেন। তাঁর আব্বাজান সম্পর্কে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি হচ্ছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঘর আর আলী হচ্ছে তার দরজা। সেই আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহুর কাছ থেকে তিনি বিদ্যা অর্জন করেন। তাঁর আব্বাজান ইসলামের চতুর্থ খলীফা নির্বাচিত হয়ে মদিনা মনওয়ারাকে রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে মুক্ত রাখার জন্য এবং মদিনার পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য খিলাফতের রাজধানী মদিনা মনওয়ারা থেকে ইরাকের কুফাতে স্থানান্তরিত করেন। ইমাম হাসান (রাদি.) ও ইমাম হুসাইন (রাদি:)সহ আলী পরিবারের সদস্যগণও কুফায় চলে আসেন। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে খারেজীদের নিযুক্ত আততায়ীর তলোয়ারের আঘাতে হযরত ‘আলী করমুল্লাহু ওয়াজহাহু শহীদ হলে হযরত হুসাইন রাদিআল্লাহ তা আলা আনহু অন্যদের সঙ্গে মদিনা মনওয়ারায় চলে আসেন। এবং অধিকাংশ সময় নানাজানের রওযা মুবারকে অবস্থান করতে থাকেন। ওদিকে নানা ডামাডোলের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার গবর্নর হজরত মু’আবিয়া রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু খলীফা হয়েছেন এবং খিলাফতের রাজধানী কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে গেছেন। হযরত মু’আবিয়া রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তিকাল করলে তাঁর ওসিয়াত অনুযায়ী তাঁর পুত্র ইয়াযীদ দামেস্কের মসনদে অধিষ্ঠিত হয়। ইয়াযীদকে খলীফা হিসাবে মেনে নিতে পারেনি তদানীন্তন মুসলিম জগতের একটা বড় অংশ। কুফার জনগণ হযরত ইমাম হুসাইনকে কুফায় এসে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য চিঠির পর চিঠি দিতে থাকে। জানা যায়, কুফাবাসীগণ দেড় শতাধিক চিঠি মদীনা মনওয়ারায় ইমাম হুসাইনের নিকট এসে পৌঁছাল। প্রতিটি চিঠিতে কুফার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর ছিল এবং তাতে এ কথাও ছিল যে কুফার জনগণ চায় আপনি কুফা এসে আব্বা হুজুর হযরত আলী রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহুর রেখে যাওয়া খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। কুফার জনগণ আপনার কুফা আগমনের অপেক্ষায় অধীর হয়ে রয়েছে। কুফা থেকে এইসব চিঠি পেয়ে তিনি তাঁর আত্মীয় স্বজনদের ডেকে কি করবেন তার সিদ্ধান্ত চাইলেন। কেউ কেউ বললেন, আপনি যাবেন না। কুফার জনগণের মত পাল্টাতে দেরি হয় না, আবার কেউ বললেন, আপনার কুফা যাওয়া উচিত, কারণ খিলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকারী তো আপনিই। শেষমেশ হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) কিছু জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও পরিবার পরিজন নিয়ে মক্কা মুকাররমা এলেন। তিনি এখানে এসে উমরাহ পালন করলেন। তিনি ইতোপূর্বে তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিল রাদিআল্লাহ আনহুকে চিঠিগুলোর সত্যতা যাচাই করে তাঁকে কুফার প্রকৃত অবস্থা জানানোর জন্য জানালেন। কুফা এসে মুসলিম বিন আকিল দেখলেন সত্যি সত্যিই কুফার নেতৃবৃন্দ ও জনগণ ইমাম হুসাইন (রাদি.) মনে মনে খলীফা হিসাবে পেতে চায়। মুসলিমের চিঠি পেয়ে ইমাম হুসাইন কুফা যাবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ওদিকে চিঠি পাঠানোর কয়েক দিনের মধ্যে ইয়াযীদ কর্তৃক কুফার নব নিযুক্ত গবর্নর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের হুকুমে মুসলিম বন্দী হলেন এবং তাঁকে হত্যা করা হলো। উবায়দুল্লাহর বাহিনী কুফার জনগণের ওপর এমন জুলুম নির্যাতন চালাল যে, তাঁরা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। ইমাম হুসাইন যাতে কুফা প্রবেশ না করতে পারেন সে জন্য রাস্তায় রাস্তায় টহলদার বাহিনী নিযুক্ত করা হলো। এত যে কা-কারখানা চলছে তা হযরত হুসাইন (রাদি.) জানতে পারলেন না। ৮ জিলহজ্জ যখন হাজীরা মিনা অভিমুখে রওনা হচ্ছেন ঠিক তখনি হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) কুফার উদ্দেশে পরিবার-পরিজনসহ ৭৮ জনের একটা কাফেলা নিয়ে মক্কা মুকাররমা থেকে রওনা হলেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কুফার কাছাকাছি হলে তিনি জানতে পারলেন মুসলিমের শাহাদাতের খবর। দূর থেকে একজন কবি উটের চলার তালে তালে উচ্চৈস্বরে ললিত উচ্চারণে গেয়ে উঠলেন : কাফেলা তুমি চলছ কোথায়? নগরীর তরবারি তোমাদের পক্ষে নয়/অথচ অন্তর তোমাকেই চায়। ইমাম হুসাইন (রাদি.) কাফেলাসহ নগরীর নিকটবর্তী হলে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের টহলদার বাহিনী কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হলেন। তারা তাঁকে নগরীতে প্রবেশ করতে দিল না। বাধ্য হয়ে তিনি ফোরাত তীরে অবস্থিত কারবালা প্রান্তে এসে ছাউনি ফেললেন। সেদিন ছিল পহেলা মুহররম, হিজরী ৬১ সন বুধবার। পরদিন সকালে দেখা গেল ‘উমর ইবনে সাদ ইবনে আবিওয়াক্কাসের নেতৃত্বে একটা বিশাল বাহিনী ইমাম হুসাইন (রাদি.) তাঁবুগুলো ঘেরাও করে চলাচলের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই ইমামের তাঁবুগুলোতে পানির অভাব প্রকটভাবে দেখা দিল। মুইয়া, মুইয়া তথা পানি পানি রব উঠতে লাগল। ফোরাত নদীর পানি আনার পথও রুদ্ধ ছিল। সে এক অবর্ণনীয় করুণ অবস্থা। তিনি শত্রু সেনাদের উদ্দেশে বললেন, কসম আল্লাহর। হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবিত নাতি শুধু আমিই। আমাকে হারালে তোমরা আমার মতো আর কাউকে পাবে না। তোমরা কেন আমাকে তোমাদের শত্রু ভাবছ? আমি কি কাউকে হত্যা করেছি, আমার দ্বারা তোমাদের কারও কি কোন ক্ষতি হয়েছে? সেই দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায় তিনি কুফার জনগণ ও নেতৃবৃন্দকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরাই তো আমাকে চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে কুফা আসতে বলেছ। তোমরা লিখেছ, আমাদের কোন ইমাম নেই, আপনার ইমমত আমরা মান্য করব। জান-প্রাণ দিয়ে আমরা আপনার পক্ষে কাজ করব। তাঁর সেই হৃদয়স্পর্শী ভাষণ শেষে হোর নামক একজন অধিনায়ক তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে ইমাম বাহিনীতে এসে যোগ দিয়ে বীর বিক্রমের যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলেন। হযরত কাসেম ইবনে হাসান (রাদি.) শহীদ হলেন, শহীদ হলেন দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগার। অতঃপর পানির পাত্র হাতে করে দুলদুল নামক অশ্বে চড়ে ফোরাত কিনারে পৌঁছে পানি নিয়ে ফেরার পথে শত্রুর নিক্ষেপিত বল্লম আর তীরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। শিমার নামক এক পাষ- তাঁর মস্তক মুবারক দেহ থেকে ছিন্ন করল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) শহীদ হবার মধ্য দিয়ে সত্যের নিশান সমুন্নত হলো। তাঁর সেই শাহাদাত যুগে যুগে মুসলিম অন্তরে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত করে। লেখক : পীর সাহেব দারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
×