ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিষয় গ্রিস

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৮ জুলাই ২০১৫

বিষয় গ্রিস

একই রাস্তায় দুই রেস্তরাঁ, দুটোই গ্রিক। দূরত্ব সাকুল্যে পঁচিশ মিটার। ‘অ্যাথেনা’ বছর দশেকের পুরোনো, ‘ক্রেটা’ হালের। শ্যোয়নেব্যার্গ জেলায়। দুই রেস্তরাঁয় জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন। সন্ধে সাতটা থেকে ভোট গণনার দৃশ্য, এথেন্স থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত। অ্যাথেনায় দর্শক উপচে পড়ছে, ক্রেটায় ভিড় কম। অ্যাথেনার প্রবেশমুখে বড়ো প্লাকার্ডে লেখা ‘নো’। ক্রেটার প্লাকার্ডে ‘ইয়েস’। দুই রেস্তরাঁ দুইভাগে বিভক্ত। খাদক ও দর্শক গ্রিক এবং জার্মান। রাত যত বাড়ে, নো-র পাল্লা যত ভারী হয় পটকা, আতশবাজির আওয়াজে বাতাস মুখরিত। ন্যয়কোলন জেলায় আরেক দৃশ্য। নো-র সমর্থকদের আনন্দমিছিল। মিছিলে গ্রিক, জার্মান এবং অন্যান্য দেশের মানুষও শামিল। জার্মানির এএফডি (অলটারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড) পার্টির এক নেতা টিভি সাক্ষাতকারে বললেন, ‘গ্রিসের জনগণ সঠিক রায় দিয়েছেন। আমরাও এই রায়ের আশায় ছিলাম। আন্তরিক অভিনন্দন।’ এএফডি-র বয়স তিন বছরও হয়নি। ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়। এগারো রাজ্যের বিধানসভায় ঢুকে পড়ছে, ইউরোমুদ্রা বাতিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানির মাতব্বরি-রোধে। জার্মানির বামদল লিংকে পার্টাই (লিংক পার্টি) গ্রিসের সিরিজা পার্টির সমর্থক, নো ভোটের পক্ষে। লিংকের নেতা গ্রেগর গিজি বলেছেন, “জার্মান শাসক দলই নো ভোটের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে মূলত। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক গ্রিসের অস্টারিটির জন্য প্রবল চাপ তৈরি করে, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস বাধ্য হন নো, ইয়েস ভোট যাচাইয়ে। জার্মানির শাসক দল প্রচ- ক্ষিপ্ত, ইয়েসের পক্ষে জোর প্রচারণা শুরু করে। নো-র বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েই ক্ষান্ত নয়, ইউরোজোন থেকে গ্রিসের বিদায় আসন্ন। এই হুঙ্কারে গ্রিসের জনগণ জার্মানির দাদাগিরি মেনে নেয়নি, জনগণের স্বাধীন মতামতে মাতব্বরির অধিকার দেয়নি। জার্মানিই নো ভোট জুগিয়েছে।” মিথ্যে বলেননি গিজি। ওপিনিয়ন পোলে (মতামত যাচাই ভোট)-র চব্বিশ ঘণ্টা আগেও দেখা গেছে হ্যাঁ ভোটের দিকে পাল্লা ভারী। অবশ্য পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা। জার্মানির বহুল প্রচারিত দৈনিক বিল্ড রবিবারের (৫ জুলাই ) সংস্করণের শিরোনাম, ৬৯ ভাগ ইয়েসের পক্ষে। গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ফারওয়াকিস আগেই জানিয়েছিলেন, ইয়েস ভোটে হেরে গেলে পদত্যাগ করবেন। জয়ের পরে পদত্যাগ করেছেন। কারণ আছে, তাঁর কথায়, আমরা সাকসেসফুল। বললেও, আসল ঘটনা অন্য। তিনি ট্রয়কাকে (ইউরোপীয় কমিশন, আইএমএফ, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক) তস্কর, টেররিস্ট বলেছিলেন। এই মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস খুশি নন আদৌ। সিপ্রাসের ধারণা, ওই মন্তব্যে, জয়ের পরেও, দাতারা জল আরো ঘোলা করবে। বিপদ বাড়বে। এখন বলতে পারবে, প্রগলভ্ ইয়ানিস বিতাড়িত। অতএব টেবিলে আসো, সমঝোতা করো। ইয়ানিসের পদত্যাগেও ইউরোজোনের কর্তাদের মন কিছুতেই ভুলবে না, তারা অপমানিত, লেজেগোবরে একাকার। যে করেই হোক, গ্রিসের বামপন্থী সরকারকে টেনে-হিঁচড়ে নামাতে হবে। জার্মানির ডেপুটি চ্যান্সেলর জিগমার গাব্রিয়েল হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘দুষ্ট ক্ষতকে’ দেখে নেবেন। জিগমার গাব্রিয়েল এসপিডি (সামাজিক গণতান্ত্রিক দল)-র। সিডিইউ (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রাটিক ইউনিয়ন)-র জোট সরকারে। গত দুই বছর ধরে সিগমার পার্টিতে (এসপিডি) কোণঠাসা, অবস্থান নড়বড়ে, যদিও তিনি পার্টি-প্রধান। উল্লেখ করা জরুরী, এই জিগমার গাব্রিয়েলই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক এবং ইউরোজোনের আরো কয়েকটি দেশে (১৯ দেশে ইউরোমুদ্রা চালু) ইউরোমুদ্রা চালুর জন্যে প্রচ- চাপ তৈরি করেছিলেন। দশটি দেশ (ইউরোজোনের) জিগমারের গোঁ পাত্তা দেয়নি। বরং বলেছে, আমরা বেঁচে গেছি। ইউরোমুদ্রার ফাঁদে পা দেব না। গ্রিসের নো ভোটে ইউরোপীয় নেতাকুলের মুখে কালি। রাগমাখা-কথা হামেশাই প্রচারিত হচ্ছে মিডিয়ায়। আশঙ্কা করছে, ইউরোজোনের আরো কয়েকটি দেশ গ্রিসের পথ ধরতে পারে। ইউরোমুদ্রার আখের নিয়ে চিন্তিত। গ্রিস নিয়ে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল জরুরী বৈঠকে সমাধান, সমঝোতার কৌশল পোক্ত করার উপায় তলিয়ে দেখলেও ট্রয়কাকে খুশি করা দুষ্কর। গ্রিসের পেটপাঁজর ঝাঁঝরা করার মতলবে এখনো অনমনীয়। স্মরণ করা দরকার, ইউরোজোন থেকে কিংবা ইউরোমুদ্রা থেকে গ্রিসকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা অত সহজ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনে ট্রয়কার সেই অধিকার নেই। গ্রিস যদি দ্রাকমা-মদ্রায় ফিরে যায়, ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন), ইসি (ইউরোপীয় কমিশন ) আরো বিপদে পড়বে। পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন গ্রিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। এই ভাবনায় ইউরোপীয় কর্তারা নিদ্রাহীন। তারপরেও মচকাতে রাজি নয়, গ্রিসকে শায়েস্তা করতে নানা পাঁয়তারা। গ্রিসকে বেলআউটে অর্থ জোগান দেব কি না, দিলে কি কি নতুন শর্তে, নানা শলাপরামর্শে দিশেহারা। গ্রিসের সরকারও নতজানু হবে না। তাদের শর্ত আছে। নো ভোটের জয়ে, গণতন্ত্রে গ্রিস আগের চেয়ে এখন বলীয়ান। লেখক : কবি, বার্লিন থেকে
×