ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী কানেকশন

চাঁপাই সীমান্তে অপ্রতিরোধ্য অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের চোরাচালান

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৩ জুলাই ২০১৫

চাঁপাই সীমান্তে অপ্রতিরোধ্য অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের চোরাচালান

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তপথে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক আনা কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে বিজিবির হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক চালান ধরা পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না এর চোরাচালান। বরং বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন। মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে ১২ কেজি গানপাউডার উদ্ধারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আবু জাফর শেখ মোহাম্মদ সংবাদ সম্মেলন করে জানান, উদ্ধার করা বিশাল পরিমাণ গানপাউডার দিয়ে সব ধরনের বিস্ফোরক তৈরি করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত শুধু বিজিবি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩ কেজি গানপাউডার উদ্ধার করেছে। এর বাইরে পুলিশ ও র‌্যাব অভিযানেও বিশাল পরিমাণ বিস্ফোরক ও অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। কয়েক মাসে তিনটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিস্ফোরকের পাশাপাশি সহস্রাধিক আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে শুধু বিজিবির হাতে ধরা পড়েছে ৪৩টি পিস্তল, একটি শাটারগান, ২৫৮ রাউড গুলি, ৬৯টি ম্যাগাজিন ও সাড়ে ৫৩ কেজি গানপাউডার। মামলা হয়েছে ৪২টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব মামলার কোন অগ্রগতি নেই। আসামিপক্ষ মামলাগুলোকে নানান বেড়াজালে ফেলে কালক্ষেপণের চেষ্টা করে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলে এমনিতেই মামলাগুলোর বাদী ও সাক্ষী নিয়ে সমস্যার কারণে আসামিরা আইনের ফাঁক দিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। বিশেষ করে বাদীপক্ষ বিজিবি সদস্য হওয়ার কারণে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলে হাজিরা জটিলতা সৃষ্ট হয়ে দিন পড়তে থাকে। এরমধ্যে সাক্ষীদের কোন না কোনভাবে হাত করায় তারা পূর্বের অবস্থান থেকে সরে যায়। ফলে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিকে বিশাল পরিমাণ বিস্ফোরক ও অস্ত্র ধরা পড়ার পরও প্রতিদিন সীমান্তপথে অস্ত্র আসা অব্যাহত রয়েছে। র‌্যাব ৩০ জুন মনাকষা ইউপির হটাৎপাড়া থেকে আহসান আলী নামের অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুটি পিস্তুল, চারটি ম্যাগাজিন ও ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধার ও আটক করে। সে গত ছয় মাসে শতাধিক অস্ত্র পাচার করে এনে বিক্রি করেছে। গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শিবগঞ্জে পুলিশের অভিযানে দুটি পিস্তল, ৫০ রাউন্ড গুলি ও চারটি ম্যাগাজিনসহ চারজন বড়মাপের অস্ত্র ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। একই সময়ে অপর অভিযানে তারাপুর বাজার থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিনসহ এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে আটক করে। একই দিন বিজিবি ফতেপুর সীমান্তের একটি বাড়ি থেকে ১৭৫ বোতল ফেনসিডিল আটক করে। বাড়ির মালিক মোঃ উবায়ের ও অপরজন মজনু দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রের সঙ্গে মাদক চোরাচালন করে আসছে। এদিকে শিবগঞ্জ পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, তারা আটক অস্ত্র ব্যবসায়ী কাফী, রুবেল, শামীম ও মাহবুবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত একাধিক সিন্ডিকেটের অন্যতম একটি সিন্ডিকেটের এই চারজন সদস্য ইতোপূর্বে কয়েক হাজার অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্বিঘেœ পৌঁছে দিয়েছে। তথ্যমতে আরও জানা গেছে, এসব অস্ত্রের সিংহভাগ খদ্দের পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর ছাত্র। এছাড়াও কয়েকটি প্রভাবশালী মহল এসব অস্ত্র কিনে ভাড়া খাটিয়ে থাকে বল জানা গেছে। অনুসন্ধানের গভীরে গিয়ে জানা গেছে, শুধু শিবগঞ্জ অঞ্চলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাচালানের ২১টি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা গত এক বছরে লাখ লাখ অস্ত্র ও শত শত মণ বিস্ফোরক পাচার করে এনে বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করেছে। বিস্ফোরকের বড় খদ্দের বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গীগোষ্ঠীর তরুণরা। এদের অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একাধিক পাবলিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে তাদের অবস্থান। এসব জঙ্গী তরুণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিহ্নিত একাধিক শিক্ষকও রয়েছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিককালে পুলিশ গোমস্তাপুর থেকে শিবিরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম সোহেলকে (২৬) একটি পিস্তল, ম্যাগাজিন ও চারটি ককটেলসহ আটক করে। গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ আহম্মেদ জানান, আটক অস্ত্রটি খুবই নতুন। এসব অস্ত্র এদের মাধ্যমে জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে চলে যায়। এসব তরুণ-যুবকের সঙ্গে শিবগঞ্জ অস্ত্র চোরাচালানকারী একাধিক সিন্ডিকেটের যোগাযোগ রয়েছে বলে ওসি ফিরোজ জানান। হঠাৎ করে অস্ত্র চোরাচালন বেড়ে যাওয়ার কারণে শিবগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর সীমান্তের চৌকা, কিরনগঞ্জ, রঘুনাথপুর, মনোহরপুর, সিংনগর, মাসুদপুর, বাগডাঙ্গা, বাখর আরী, হাকিমপুর বকচর, পোল্লাডাঙ্গা, সোনামসজিদসহ ৩১ সীমান্তপথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি বাড়িয়েও অস্ত্র চোরাচালান রুখতে পারছে না। একটি সূত্র জানায়, মনাকষা ও বিনোদপুর এলাকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের উঠতি মাস্তান ও জেলা শহরের এক শ্রেণীর প্রভাবশালীর সহযোগিতায় অস্ত্র, গুলি গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি আম ব্যাপারি সেজে বহু অস্ত্র ব্যবসায়ী চাঁপাই অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে ভারতের মালদহ, কালিয়াচক, মোজামপুর, দৌলতপুর, সরদলপুর, শোভাপুর, নিমতিতা, চুরি অনন্তপুর, শশ্মানী, বৈষ্ণবনগর, গোপালগঞ্জ, ফারাক্কা, জঙ্গীপুর, ধুলিয়ান আওরাঙ্গাবাদ, সাইদপুরসহ বিহারের ২১টি পয়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে অস্ত্র এনে আমের ঝুড়িতে ভরে গন্তব্যে পাঠাচ্ছে। এদিকে দেশের কানসাট আমবাজারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও চিহ্নিত চোরাকারবারি মালদহ এলাকায় আমবাগান কিনে রেখেছে। তারাও আমের ঝুড়িতে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক এনে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাচ্ছে। শিবগঞ্জ এলাকায় ৪১ জনের একটি বড় সিন্ডিকেট এই অস্ত্র ব্যবসা সরাসরি করে চলেছে। এসব চিহ্নিত চোরাকারবারির অধিকাংশ এখন আমদানি-রফতানিকারক সেজে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে অবস্থান নিয়েছে। বর্তমানে তারা কানসাটে আমের আড়তও করেছে। উল্লেখ্য, অস্ত্র বহনে বাড়িতে ছুটিতে আসা আইন প্রয়োগকারীদের একাধিক সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অস্ত্রভর্তি আমের ঝুড়ি বহনে ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। সীমান্তজুড়ে বিজিবি বাড়তি সতর্কতা নিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখায় প্রতিদিন ছোটখাটো অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য, বিশেষ করে ফেনসিডিল আটক করে চলেছে। অনেকের অভিমত, আইন প্রয়োগকারীদের তত্ত্বাবধানে বা উপস্থিতিতে আমের ঝুড়ি তৈরি ও পরিবহনে (ট্রাকে) ওঠানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে অস্ত্র চোরাচালান কমে আসবে।
×