ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তি দিয়ে যুদ্ধ জয়

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৫ মার্চ ২০১৫

যুক্তি দিয়ে যুদ্ধ জয়

‘অজয় স্যার, সবিনয় নিবেদন’ নামে একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম। তাতে বলেছিলাম, মস্তিষ্কের সহানুভূতি দিয়েই আমরা মানুষ। আজকের সংযোজন, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কেননা সমগ্র প্রাণিকুলে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ ধীশক্তির অধিকারী। কারণ, মানুষ মাত্রই ভাল-খারাপ, আলো-অন্ধকার সহজেই বুঝতে পারে। আমরা বিচারবুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। পেশাদার খুনী না হলে একজন আরেকজনকে খুন করতে বললেই কেউ খুন করতে যাবে না। একজন পেশাদার খুনীর রোজগার হয় খুন করে। সেও কিন্তু যুক্তি খাটায়। বড় মাপের মানুষকে খুন করতে অনেক বেশি টাকা দিতে হয়। আমার ধারণা, আমরা খুন-খারাবির সময়টা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছি। মানুষ হিসেবে আমরা বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক দু’ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। এক. সিস্টেমেটিক পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। দুই. সহজ বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশে এক সময় কবি গানের লড়াই হতো। সেই কবি গানের লড়াইয়েও হারজিত ছিল। কিন্তু আসল কথা দর্শকগণ সেই যুক্তিনির্ভর কবিয়ালদের যুদ্ধটা উপভোগ করত। পাঠকবৃন্দ ভাবুনতো একবার, এই দিনেরে সেই দিনে নিয়ে গেলে কেমন লাগত? সম্প্রতি সৌদী এক ক্লেরিক বলেছেন, পৃথিবী ঘোরে না। পত্রিকা এবং ইন্টারনেটে খবরটার পেছনে যুক্তি খুঁজছিলাম। পাইনি। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ৪৭ জন সিনেটর ইরানকে চিঠি লিখে যুক্তি দিয়ে বলতে চেয়েছেন, ওবামা-কেরির সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তি করে লাভ নেই। দু’বছর পর যখন ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকবেন না তখন চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। কাজটা কিন্তু রীতিমতো বাংলাদেশের বিরোধী গ্রুপের হরতাল-অবরোধের সমতুল্য। এ নিয়ে যুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টকে অগ্রাহ্য করে চিঠি লেখাটা উচিত হয়েছে কিনা। এবার সহজ কথায় ফিরে আসি। একটা গ্লাসের অর্ধেক পানি থাকলে আপনি বলতে পারেন গ্লাসটির অর্ধেক খালি, আবার আমি বলতে পারি গ্লাসটির অর্ধেক পানি। আমরা দু’জনেই সত্যি কথা বলছি। কিন্তু আমার কথায় একটা পজেটিভ এ্যাটিচুড ফুটে উঠেছে। আপনি কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার খবরের শিরোনাম দেখেই বলতে পারবেন কোন্দিকে বাতাস বইছে। একই ঘটনার নানাবিধ শিরোনাম হতেই পারে। মুক্ত বুদ্ধির চিন্তা তো এইজন্যই। এই যে ধরুন, গত এক বছরের অধিককাল বিএনপির আন্দোলনের কি কিছুই পজেটিভ দিক নেই? নিশ্চয়ই আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ হয়ত বলবে, গত এক বছর তুলনামূলক কম দুর্নীতি হয়েছে, উন্নয়ন কাজ তুলনামূলক বেশি হয়েছে। কেন হয়েছে? বিএনপি যাতে আর কোন কথা বলার সুযোগ না পায়, যেমনটা পেয়েছিল গত বছরের নির্বাচনের আগে। গত নির্বাচনের আগে পত্রপত্রিকার দুর্নীতি ছাড়া আর কোন খবর থাকত কি? ব্যাংকের লোন কারচুপি, ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট বা পাচার, টাকার বস্তা ঢাকার রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছে, কেউ বলে না এগুলো কার টাকা? আওয়ামী লীগ সরকারের সেই অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই জয়ের মুখ দেখতে পেত। সাধারণ জনগণ গরিব হতে পারে, কিন্তু দুর্নীতি সহ্য করার মতো নির্বোধ নয়। তাছাড়া নিজেদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলেই তা বুঝতে কষ্ট হতো না। এক সময় বিএনপির আমলে দুর্নীতি ও দুঃশাসন হাওয়ায় উড়েছে, আর সেইজন্যই বিএনপির পতন হয়েছিল। একইভাবে বিগত নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেই আওয়ামী লীগের পতন ঘটত। আর যদি স্থূল কারচুপির জন্য বিএনপি হেরেও যেত তাহলেও বর্তমান আন্দোলনের একটা যৌক্তিকতা থাকত। বিএনপির সেই ভুলের ফলে এই সরকার ইতোমধ্যে ‘১২ ইঞ্চি ওয়াল দিয়ে বাড়ি’ তুলে ফেলেছে। সারা বিশ্বে সেই বাড়িটা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এমতাবস্থায় আপনারা সেই বাড়ি ভাংতে পারবেন না, কেননা, বাড়িওয়ালার শক্তিও তো কম নয়। সুতরাং এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে যুক্তি বেশি, বিএনপির পক্ষে কম। তাছাড়া বিএনপির আন্দোলন তো জনগণের কল্যাণের জন্য হচ্ছে না। জনগণকে মেরে কি জনগণের কল্যাণ আসবে? আওয়ামী লীগ একটা বছরে জনগণকে কিছুটা হলেও স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে। তারপর, এ কেমন কথা আপনারা (অর্থাৎ বিএনপি) বলছেন? যারা পেট্রোলবোমায় দগ্ধ বা মৃত তাদের ‘নতুন মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তার মানে আপনারা পরোক্ষভাবে এই মৃত্যুকে স্বীকৃতি দিয়ে বলতে চাইছেন, তোমরা আরও মরো, আমরা স্বীকৃতি দেব। তবুও বাংলাদেশের জনগণ কিছুটা হলেও খুশি আপনারা আপনাদের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিতে তাদের ‘শহীদ’ হিসেবে ঘোষণা দেননি। যুক্তিবিহীন কথায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভোটারদের আপনারা টানবেন কি করে? তাহলে আপনারা এখন কি করবেন? আপনাদের কিন্তু অনেক কিছুই করার আছে। যেমন, বছরের পর বছর লঞ্চডুবি হয়েই যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ভারতে এরকম ঘটনা ঘটলে মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই পদত্যাগ করত। আপনারা স্টাডি করুন, প্ল্যান করুন, তারপর জনগণকে বলুন কিভাবে এই লঞ্চডুবি বন্ধ করবেন, আপনারা ক্ষমতায় গেলে? বাংলাদেশের জনগণও এখন খুব এনালাইটিক্যাল। আপনাদের শুধু বললেই হবে না, ক্ষমতায় গিয়ে সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন। কি করে করবেন সেদিকে জোর দেন। তারপর, এই যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, বড় ধরনের দুর্নীতিতে লিপ্ত, আপনারা বলুন কিভাবে তা বন্ধ করবেন? এবার শিক্ষার কথায় আসি। ইতোমধ্যে আপনারা কিন্তু হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর মাধ্যমে শিক্ষাকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে ফেলেছেন। আপনাদের দলেতো প্রচুর নামকরা শিক্ষাবিদ আছেন। তাঁরাও কি একই চিন্তা করেন? লাগাতার অবরোধ, লাগাতার হরতাল, অন্য কোন কারণেই কি আপোস করা যায় না? সরকার তো ইচ্ছে করে তখন পরীক্ষার তারিখ দেয়নি। আপনারা ক্ষমতায় গিয়ে তাদের পরীক্ষা ছাড়াই পাস করিয়ে দেবেন? নাকি একটা একাডেমিক বছর বাদ দিয়ে দেবেন? এই ছাত্র-ছাত্রীরা যখন ভোটার হবে তাদের ভোট তখন কোন্্দিকে যাবে? বরং সোচ্চার হোন শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ঘুণ ধরেছে তা দূর করবেন কি করে। দলমত নির্বিশেষে দেখুন, বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে খুশি হয়? আমাদের ‘বাঘরা’ বিশ্বকে কেমন চমকে দিয়েছে? এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে পারফরমেন্স দেখিয়েছে তাতে কি প্রমাণ হয়? আমরাও পারি। ওবামা তো ‘ডব পধহ’ সেøাগান দিয়েই প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সারা বিশ্বকে জানিয়ে আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজা ইংল্যান্ডের সঙ্গে জয়লাভটা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেছে। কি দারুণ একটা কথা বলেছে। সারা বিশ্ব শুনেছে মুক্তিযোদ্ধা কথাটা। আমরা কখনই পরিচিত হতে চাই না আমরা কোকের বোতল দিয়ে পেট্রোলবোমা আবিষ্কার করেছি। দল হিসেবে জনগণের মাঝে বিএনপির সমর্থক নিশ্চয়ই আছে। বর্তমান সরকার জেল হাজত ভরে ফেলছে, তারপরও পেট্রোলবোমা বন্ধ হয়নি। শুধু তাই নয়, সুশীল সমাজের সমর্থনও আছে। আর সমর্থন আছে বলেই ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়। একটা কথা রাজনীতিবিদরা অবশ্যই মানবেন, দেশের ক্রাইসিসের সময় সাধারণ জনগণ যে কথা বলতে পারে, রাজনীতিবিদরা অবশ্যই তা বলতে পারেন না। জনগণ অবশ্যই আলোচনা করতে পারে- পেট্রোলবোমা, ককটেল মারা বন্ধ হচ্ছে না, সাধারণ মানুষের মৃত্যু বন্ধ হয়নি, সুতরাং সেনাবাহিনী নামা উচিত। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ কখনও তেমন কিছু নিয়ে গোপনে শলাপরামর্শ করতে পারেন না। তাছাড়া সে শলাপরামর্শ যদি হয় সরকারের বিরুদ্ধে এবং লাশ ফেলা নিয়ে। এরকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই বাংলাদেশে অতীতে অনেক হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে । বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতার বাইরের দলগুলো ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কি করতে পারে? তবে সাধারণ জনগণকে না মেরে যদি বিকল্প কোন আন্দোলন থেকে থাকে, তাই করুন। শক্ত যুক্তির ওপর নির্ভর করে জেদ করা যায়, কিন্তু দুর্বল যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে জেদ করাটা ভালর চাইতে মন্দের সম্ভাবনাই বেশি। এক সময় বিএনপি সংলাপে যেতে চায়নি, আর এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংলাপের জন্য তারা হন্যে হয়ে পড়েছে। ঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করার কারণেই দুই দফায় কয়েকশত সাধারণ লোকের প্রাণহানি ঘটল। আবারও সবিনয়ে নিবেদন করছি, নিরীহ সাধারণ মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে আপনারা যাই করুন কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। লেখক : অধ্যাপক মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর ওম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র
×