ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

শিরীন শারমিন চৌধুরীর উদ্দেশে

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৪

শিরীন শারমিন চৌধুরীর উদ্দেশে

শিরীন শারমিন চৌধুরী : আপনি কি জানেন বাংলাদেশের এক আশ্চর্য ভবন এখন আপনার হাতে। এই ভবনটি সৃষ্টি করেছেন লুইকান পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলে, কিন্তু তিনি ভবনটি অসমাপ্ত রেখে পরপারে চলে গেছেন। অসমাপ্ত ভবনটি পাকিস্তানী প্রভুদের বিরুদ্ধে একজন স্থপতির চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে এই চ্যালেঞ্জ আমাদের ওপর তার কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্বের নির্দেশনা। পাকিস্তানী প্রভুরা স্থপতির চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করেছেন, আর আমরা স্বাধীন নাগরিকরা দায়িত্ব পালন করিনি। তবু এই ভবন, সংসদ ভবন, সব অবজ্ঞা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ হচ্ছে : এই ভবনটি ট্রান্সপারেন্ট ও সলিড, ওপেন ও ক্লোজড, ভবনটি ঘিরে আছে একটি লেইক প্যাভিলিয়ন। ভবনটি হচ্ছে শিল্প ও স্থাপত্যের এক সুচারু ল্যান্ডস্কেপ সেটিং; ভবনটি লুইকান সৃষ্টি করেছেন, ডিজাইন করেছেন এবং নির্মাণ করেছেন : সব মিলিয়ে ভবনটি এক শিল্পকর্ম। ভবনটি অসমাপ্ত, সমাপ্ত করার দায়িত্ব আইন প্রণেতা ও স্পীকারের, সমাপ্ত করার দায়িত্ব বাংলাদেশের মানুষের। এখন পর্যন্ত এই দায়িত্ব কেউ পালন করেননি। অসমাপ্ত ভবনটি আমাদের দিকে চেয়ে আছে। ভবনটি ট্রান্সপারেন্ট এক স্থাপত্য, বিশাল এক ক্যানভাস এবং ভাস্কর্যের ল্যান্ডস্কেপ সেটিং। আমরা দেখি, অবাক হয়ে দেখি এই ভবনটিকে। লুইকানের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল শেরে বাংলানগরের শূন্য বিরান ছড়ান জমিনে একটি ভবন তৈরি করার। ভবনটি সংসদ ভবন, ঔপনিবেশিক পূর্ব পাকিস্তানে জাঁকালো ভবন রাষ্ট্র কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করার রেওয়াজ ছিল না, ঔপনিবেশিক পূর্ব পাকিস্তানে বারবার গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন দেশটির অসম্ভব প্রিমিটিভ সৌন্দর্য, যা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে হয় সরল; কিন্তু এই সরলতা প্রতারক, একই সঙ্গে অসাধারণ এক পরিশিলীত সংস্কৃতির শক্তি। এই সংস্কৃতি একটি সভ্যতার অপ্রতিরোধ্য অগ্রসর হওয়ার চিহ্ন। লুইকান স্থপতি চোখ দিয়ে একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা আবিষ্কার করেছেন, উদ্ভাবন করেছেন তার বিভিন্ন বিজয়, ঔপনিবেশিক প্রভুরা এই শক্তি এই বিজয় খুঁজে বার করতে চাননি। তাঁর মৃত্যু ট্র্যাজিক : তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর অন্যতম বাংলাদেশে ও ভারতে, এখনও মাটির ভিতর থেকে সম্পূর্ণভাবে উত্থিত হয়নি। তিনি স্থাপত্যের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন এমন সব তুলনাহীন ঐশ্বর্য যে সব ঐশ্বর্য তাঁর যুগের মাস্টার ওয়ার্ক, বিংশ শতাব্দীর মুকুট, সকল সময়ের শ্রেষ্ঠ শিল্প। তিনি স্বীকৃতির এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন ধীরে ধীরে, কোন ঢোল না বাজিয়ে, আজ মেনে নেয়া হচ্ছে তার সৃষ্টিশীল কৃতিত্ব। তাঁর কৃতিত্ব : তাঁর মৃত্যুর ট্র্যাজেডি তাঁর কাজগুলোকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর শেষ কাজটি দেখার জন্য, যে কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত ভাষা, যে ভাষায় যুক্ত কবিতা ও দর্শন। ঢাকার কাজটি তাঁর শেষ কাজ এবং এই কাজটিতে তিনি মিলিয়েছেন তাঁর রচিত স্থাপত্যের কবিতা ও তাঁর নিজস্ব দর্শন। একটা সত্যের দিকে তিনি যাত্রা করেছেন, একটা সর্বজনীন সত্য তিনি ধরতে পেরেছেন। তিনি স্থাপত্যে সব সময় একটা অর্থ খুঁজে বেড়িয়েছেন : একটা দেয়াল, একটা ছাদ, একটা দরজার অর্থ কিংবা যেভাবে আলোক তৈরি করে কাঠামোর ভিতর কাঠামো, কিংবা ভবনটা কি হতে চায় সেই রহস্য। তিনি খুঁজেছেন মৌল জবাব শিল্প ও মানবিকতার হাত ধরে। তিনি চেষ্টা করেছেন স্থাপত্যের পুনর্উদ্ভাবন : ভবনের বাস্তবতার শুরু ও শেষ। তিনি সব সময় মেটিরিয়ালকে প্রশ্ন করেছেন : কি হতে চাও তোমরা। আহমেদাবাদ ও ঢাকায় তিনি জবাব পেয়েছেন: আমরা ইটের আর্চ চাই। এক্সটারে তিনি জবাব পেয়েছেন: ইটের আর্চে কংক্রিটের অধিকতর সাপোর্ট চাই, আর চাই অক্ষিগোলকের জানালা। এই জানালার সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন ঢাকার কাজটিতে। অক্ষিগোলকের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশকে তিনি দেখেছেন, উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কবিতা ও দর্শন, লড়াই করেছেন কলোনিয়াল ইতিহাস ও দর্শনের বিরুদ্ধে। যে স্টাইল তিনি খুঁজে পেয়েছেন সে স্টাইল তিনি পেয়েছেন বহু অন্বেষণের পর। স্টাইলটা অতীত ও বর্তমান থেকে তৈরি করা। এই সমন্বয় একটা বিরল মুহূর্ত যখন আধুনিকতা হাত ধরে থাকে ইতিহাসের। স্টাইলিস্টিক সমন্বয়ের মধ্যে আছে অসম্ভব শক্তি। এই শক্তি থেকে উত্থিত হয়েছে আধুনিকতা এবং স্থাপত্যের বিপ্লব। তিনি তাঁর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেঁটেছেন এবং তার সময়ের পর তীরে পৌঁছেছেন। একজন ব্যক্তির পরিশীলিত সাহস এ ক্ষেত্রেই। আধুনিক আন্দোলনের পশ্চাৎপট থেকে তিনি আগামীর দিকে তাকিয়েছেন। তিনি যখন ইটের দেয়াল ও আর্চের দিকে ফিরে তাকান সে ক্ষেত্রে যুক্ত করেন রিএনফোর্সড কংক্রিট, হাতে ধরেন ইন্টারন্যাশনাল স্টাইলের। তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেন লুই কুর্বেকে এবং পার্থেননকে বাংলাদেশের ও ভারতের পরিসরে। তাঁর ভবনগুলো শক্ত সমর্থ এবং লাবণ্যময়, তাদের উপস্থিতি নজরকাড়া। ভবনগুলো তার যুগের এবং একই সঙ্গে সর্বযুগের। তাঁর শেষ কাজটিতে, সংসদ ভবনের কাজটিতে আছে এক প্রিমিটিভ সৌন্দর্য, প্রতারক এক সরলতা, অপ্রতিরোধ্য পরিশীলতা। লুইকান, এই অর্থে, একজন আর্কিটেক্ট কেবল নন, তিনি ইতিহাসবিদ, তিনি সংস্কৃতির উদ্ভাবক। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সাহসকে কলোনিয়ালকালে তিনি ধরে রেখেছেন। তিনি ভবনে এনেছেন ফর্ম ও শৃঙ্খলা; এই ফর্ম ও শৃঙ্খলা থেকে তিনি খুঁজে বার করেছেন দেশ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। যদি কেউ, কোন ব্যক্তি, কোন বাঙালী চোখ প্রগাঢ় করে দেখে, তাহলে দেখতে পাবে অজস্র জলাধার এবং জলাধারগুলোকে ঘিরে আছে শুকনো বিরান জমি, দিগন্তছোঁয়া পানি ও শুকনো জমির ঢেউ, তার মধ্যে বসবাস করছে সাধারণ মানুষ। এই মানুষগুলো এখন আর নেই। সেই সামাজিক প্রয়োজনকে, লুইকান, মেটিরিয়াল ও কাঠামোকে একটি মানবিক সমগ্রে রূপান্তরিত করেছেন। এই হচ্ছে বাস্তবতা, যে বাস্তবতাকে তিনি জীবন্ত করেছেন বিরান জমি, শুকনো জমি, অসংখ্য নদী ও মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে। সে জন্য বাংলাদেশের সংসদ ভবন হচ্ছে ক্ষমতা ও লাবণ্যের একটা এবস্ট্রাক্ট জ্যামিতি: তিনি তাঁর অনুভবগুলো উজাড় করে দিয়েছেন এখানে, তার চোখ দিয়ে পরিকল্পনা করেছেন সারাদেশ যাতে ভবনটিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। চারপাশে উর্বর জমি ও চারপাশে টলটলে পানির মধ্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন একটি কেন্দ্রীয় ইনটেরিয়র স্পেস: একটি ভবন। অন্যদিকে ভবনটি হচ্ছে একটি স্পেস, উড়ে চলেছে আকাশে, আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে ওপর থেকে ও ঘিরে ধরেছে ন্যাটিভ ন্যাচারাল কংক্রিট দেয়াল, তার মধ্যে বিশাল সার্কুলার খোলামেলা জায়গা। এভাবে স্পেসটা দর্শকের চোখে এক আশ্চর্য ড্রামা মেলে ধরেছে। একটা বদ্ধ স্পেস কিভাবে সার্কুলার হয়ে যায়, কিভাবে একটা সার্কুলার স্পেস আলোকিত দেয়াল হয়ে যায়, কিভাবে অলোকিত দেয়াল আকাশে ডানা মেলে দেয়: আমাদের দেখার কোন কুলকিনারা নেই। এমন ভবন আগে কখনও জন্মায়নি (আমি জন্মানো শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করেছি)। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দাঁড়িয়ে ইতিহাসের দিকে চোখ মেলা যায়, আর ইতিহাস হয়ে ওঠে অতীত ছাড়ানো ভবিষ্যত: কলোনির মধ্যে আমাদের ধরে রাখা যায় না। তার তৈরি সংসদ ভবন হচ্ছে এক মনুমেন্টাল সিম্বল: প্রাচীন ও ভবিষ্যত সভ্যতার মেলবন্ধন। এই মানুষটি ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর শেষ ওয়ার্কিং ট্রিপে। তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা ফিলাডেলফিয়ায়, সোমবার ক্লাস নেবেন। মানুষটি নিউইয়র্কের পেনসিলভিনিয়া স্টেশনের পুরুষদের রেস্টরুমে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। তিন দিন সিটি মর্গে শুয়েছিলেন, যতদিন না তাঁর শব চিহ্নিত হয়। এই মানুষটি বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে মানুষকে খুঁজেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে কেউ ছিল না। ঢাকার সংসদ ভবনের মুকুট মাথায় পরে এই মানুষটি তিন দিন শনাক্তহীন অবস্থায় মৃত্যুর দু’হাতের মধ্য শুয়েছিলেন। কেউ তাঁর কাছে ছিল না, আর্কিটেক্ট বন্ধুরা কেউ কাছে ছিল না, তাঁর পরিবার পরিজন কেউ কাছে ছিল না, তাঁর ছাত্ররা কেউ কাছে ছিল না। তাঁর শীতল শরীরে, তাঁর অদম্য চোখে, তাঁর তৈরি বিভিন্ন মাস্টারপিস : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের মানুষদের শেষ সালাম। বাংলাদেশে কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর স্বপ্ন, তাঁর চিন্তা, তাঁর বোধ, মানুষকে বুঝবার প্রয়াশ : একটা ভবনের চেহারা নিয়ে আমাদের জন্য এক সাংস্কৃতিক উপঢৌকন। ঢাকা থেকে আর কখনও ফিরে যেতেই পারেননি তাঁর দেশে, তাঁর জন্মস্থানে। ঢাকাকে তিনি দিয়ে গেছেন সময়হীন একান্ত ও লাবণ্যময় এক ভবন। আর ট্র্যাজিডি হচ্ছে ভবনটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় বাংলাদেশের কাছে তাঁর উপঢৌকন। তাঁর ওপর এক আশ্চর্য ফিল্ম তৈরি করেছেন তাঁর ছেলে : ন্যাথানিয়েল কান। ফিল্মটির নাম : মাই আর্কিটেক্ট। ন্যাথানিয়েল বিবাহবহির্ভূত পুত্র লুইকানের। ফিল্মটি হচ্ছে পুত্রের হোমেজ পিতার প্রতি। পুত্র কি খুঁজছেন ফিল্মটিতে? পিতাকে? পিতার রচিত বিভিন্ন ভবনকে? পিতার বিভিন্ন বিবাহবহির্ভূত প্রেমকে? ফিল্মটি হচ্ছে আর্কিটেকচারাল ফটোগ্রাফির এক ড্রামা। লুইকানকে ঢাকায় এনেছিলেন মাযহারুল ইসলাম। তিনি নেই, কিন্তু আছেন রবিউল হুসাইন এবং শামসুল ওয়ারেস। এই দু’জন লুইকানের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁর চিন্তা, স্বপ্ন, মেটিরিয়াল ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন। মেট্রো রেল, বিভিন্ন কবর, বিভিন্ন ব্যক্তির বাসস্থানের জন্য সংসদ ভবনের জায়গা বরাদ্দ নয়। বাঙালী জাতির স্বপ্ন দেখার, সংকল্প প্রণয়ন করার, বাস্তবের মধ্যে বাস্তব অন্বেষণ করার জায়গা এখানে। এই সংসদ ভবনে। সেজন্যই শিরীনের দায়িত্ব ভবনটি সমাপ্ত করা, ফিল্মটি সংগ্রহ করা, একই সঙ্গে সংগ্রহ করা লুইকানের সংসদ স্থাপত্য বিষয়ক ড্রইং স্বপ্ন চিন্তা। রবিউল এবং ওয়ারেস-এর সঙ্গে একত্রে কাজ করে লুইকানকে আমাদের কাছে শিরীন ফিরিয়ে দেবেন এই আশা করা অন্যায় নয়।
×