
মাছ শুধু আমাদের খাদ্য নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, জীবিকা, নদীভিত্তিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঠিক সেই জায়গা থেকেই এবছরও সারাদেশে শুরু হয়েছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫, যা উদযাপিত হচ্ছে ২২ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত। এবারের প্রতিপাদ্য-“অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশীয় মাছে দেশ ভরি”। শুধু একটিমাত্র স্লোগান নয়, এটি টেকসই জীবিকা, পুষ্টি এবং পরিবেশ সুরক্ষার প্রতি আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকারের প্রতীক।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়, হাওর-বাঁওড়, নদী আর সমুদ্র উপকূলজুড়ে গড়ে উঠেছে এক বিশাল মৎস্যসম্পদের ভাণ্ডার। মৎস্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪০ লাখ হেক্টরের বেশি জলাশয় রয়েছে, যার মধ্যে ৩.৮৬ লাখ হেক্টর মুক্ত জলাধার এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চল মৎস্যসম্পদে ভরপুর।
বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন এখন ৫০ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি, যা জাতীয় জিডিপিতে ২.৫৩ শতাংশ অবদান রাখছে। সবচেয়ে আশার কথা, দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে দেশের প্রতি ব্যক্তি দৈনিক মাছ ভোগের পরিমাণ ৬৭.৮০ গ্রাম, যা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
সারাদেশে বর্তমানে ৬৬৯টি অভয়াশ্রম কার্যকর রয়েছে, যেখানে দেশীয় ও বিপন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) উদ্ভাবন করেছে ৮৭টি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন, মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং খামার ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটেছে। চিতল, বোয়াল, খলিসা, টেংরা এমন ৪১টি বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ করে বর্তমানে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ২.৭১ লক্ষ টন, যা পূর্বের তুলনায় চারগুণ বেশি। এই খাতে ৫০০টিরও বেশি হ্যাচারি কাজ করছে এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
হাওরাঞ্চলের অবদানও অনন্য প্রতি বছর এখান থেকে আহরণ হচ্ছে ১.২৮ লক্ষ টন মাছ, যা দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণের প্রায় ৯.১ শতাংশ। এবছরের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৩ জুলাই, ঢাকার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মৎস্য প্রযুক্তি প্রদর্শনী, জাতীয় পুরস্কার প্রদান, নদী তীর ও হাটবাজারে সচেতনতা প্রচারাভিযান, বাজার পর্যবেক্ষণ ও মৎস্য আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম।
সরকারের লক্ষ্য বিজ্ঞানভিত্তিক, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই মাছচাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা। এটি শুধুমাত্র খাদ্য বা পুষ্টির বিষয় নয়, বরং এটি জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনার টেকসই ভবিষ্যতের পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই দেশ নদী ও মাছের দেশ, এবং সেই পরিচয় ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। মাছের টিকে থাকা মানে একেকটি পরিবার, একেকটি পেশা, একেকটি অঞ্চলের জীবনের টিকে থাকা।
“দেশীয় মাছে দেশ ভরি” এই প্রতিজ্ঞা হোক বাস্তবায়নের অঙ্গীকার। টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাক এক পরিবেশ-সচেতন, পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
আফরোজা