ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

জলাবদ্ধতা ও নগর ব্যবস্থাপনা: সংকট এবং উত্তরণের উপায়

ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ২৮ জুলাই ২০২৫

জলাবদ্ধতা ও নগর ব্যবস্থাপনা: সংকট এবং উত্তরণের উপায়

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের নগরায়ন আজ এক অনিবার্য বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নগরবাসীর সংখ্যা, বাড়ছে বহুতল ভবন, শিল্পকারখানা ও যোগাযোগ অবকাঠামো। কিন্তু এর বিপরীতে নগর ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা একটি গুরুতর সংকটে পরিণত হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব প্রধান শহরে বৃষ্টির পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এ সংকট নগরজীবনে যেমন দুর্ভোগ ডেকে আনে, তেমনি পরিবেশ ও অর্থনীতিতেও ফেলে নেতিবাচক প্রভাব।

জলাবদ্ধতার মূল কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে অপরিকল্পিত নগরায়ন। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব দেখা যায়। যত্রতত্র নির্মাণ কাজ, ফুটপাত ও সড়কের দখল, এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেক পুরোনো শহরে এখনও শত বছরের পুরোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থাই ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বর্তমান জনসংখ্যা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সামলাতে একেবারেই অকার্যকর। একইসাথে ড্রেন ও খালের ওপর অবৈধ দখল এবং ময়লা-আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে ফেলা প্রাকৃতিক জলপ্রবাহের পথ জলাবদ্ধতাকে আরও তীব্র করে তোলে।

আবার, অপর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন নগরের হাইড্রোলজিক ব্যালান্সে ব্যাঘাত ঘটায়। জলাধার, খাল-বিল, পুকুর এসব প্রাকৃতিক জলাভূমি বিলুপ্তির ফলে পানি জমে থাকার স্থান সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত অপসারিত হতে পারে না। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্বাভাবিক ও ভারী বৃষ্টিপাতের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় জলাবদ্ধতার তীব্রতা আরও বেড়েছে।

জলাবদ্ধতার কারণে নাগরিক জীবনে ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। যানজট, জলাবদ্ধ রাস্তায় চলাচলের অক্ষমতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছাতে না পারা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি, পানি দূষণের ফলে রোগবালাই বৃদ্ধি; এসব হলো এর সরাসরি প্রভাব। অর্থনৈতিকভাবে এ সমস্যা বহু প্রকার ক্ষতি ডেকে আনে; যেমন, ট্রান্সপোর্ট খরচ বৃদ্ধি, চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। পরিবেশগত দিক থেকেও এর প্রভাব ভয়াবহ; পানিদূষণ, মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি, ড্রেনের গ্যাস নির্গমণ, জলজ বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস এসব তো রয়েছেই।

এই সংকটের উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও বাস্তবমুখী নগর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। প্রথমত, ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য। নালাগুলো পরিষ্কার রাখা, জলাধার ও খাল পুনরুদ্ধার করা এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। প্রাকৃতিক জলধারার গতিপথ সংরক্ষণ এবং "ওয়াটার সেন্সিটিভ আরবান ডিজাইন (WSUD)" পদ্ধতির মাধ্যমে নগর পরিকল্পনায় পানি ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

নগরের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) চালু করা যেতে পারে, যা একদিকে পানি সংরক্ষণে সাহায্য করবে, অন্যদিকে ড্রেনের ওপর চাপও কমাবে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের বিকল্প খুঁজতে হবে। ভবিষ্যৎ নগরায়নে সবুজ এলাকা, জলাধার ও খাল সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় সরকার ও নাগরিক সমাজকে যুক্ত করে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো উচিত।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্লাস্টিক, পলিথিন ও কঠিন বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা বা ড্রেনে ফেলা বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নগরের প্রতিটি নাগরিককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশাসন, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, পরিবেশবিদ ও সাধারণ নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে।

পরিশেষে বলা যায়, জলাবদ্ধতা নিছক একটি বর্ষাকালীন সমস্যা নয়; এটি একটি কাঠামোগত ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। এই সংকটের সমাধান সুদূরপ্রসারী, বাস্তবভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব নগর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সম্ভব। সময় এসেছে সংকটকে উপলব্ধি করে সমাধানের পথে হাঁটার, না হলে আগামী দিনে নগরজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

আফরোজা

×