
মাত্র ১০ বছর বয়সী সামিয়া আক্তার। ছোট্ট শরীর। এই শরীরে আগুনের পোড়া ক্ষত। দুই হাত, মুখমণ্ডলসহ বিভিন্ন স্থানে পুড়ে গেছে তার। পোড়া স্থানে ফোসকা পড়েছে, ফুলে গেছে। আগুনের তাপ লেগেছে শ্বাসনালীতেও। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে শিশুটি জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫ম তলার পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিল।
রাত থেকে ওয়ার্ডের বাইরে ফ্লোরে বসে সন্তানের জীবন ভিক্ষা চেয়ে আল্লাহর কাছে হাত তোলেন বাবা-মা। অপেক্ষায় আছেন চিকিৎসকরা কোনো ভালো খবর নিয়ে আসেন কি না। কিন্তু... হঠাৎ খবর এলোÑ সামিয়ার অবস্থা খারাপ। তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। এমন খবরে সামিয়ার শোকাহত বাবা-মা আরও হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
জীবন শঙ্কায় থাকা সামিয়াকে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সামিয়ার শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আগুনের তাপ শ্বাসনালীতে লাগায় অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিয়েছে। শ্বাস নেওয়ার সময় সাঁ সাঁ করে শব্দ হচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে।
মা শিউলি আক্তার ও বাবা আব্দুর রহিম জানান, সামিয়া মাইলস্টোন স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ত। আব্দুর রহিম বলেন, ঘটনার পর পরই যখন মেয়েকে বের করলাম, তখন ওর শরীরে তেমন কোনো পোড়া দেখিনি। সবকিছু স্বাভাবিক। চোখে কোনো পানি দেখিনি। কিন্তু ওর চোখে আমি ভয় দেখেছি। হাসপাতালে আনার পর আস্তে আস্তে হাত, মুখে ফোসকা পড়া শুরু হয়। এরপর ফুলে গেছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, শ্বাসনালীতেও তাপ লেগেছে।
আমরা তো ভাবছি, ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর পর গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসতাম। কিন্তু হঠাৎ করে চিকিৎসকরা জানালেন, ওর অবস্থা খারাপ, লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। এখন সেখানে আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার মেয়েটা কি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে? এমন প্রশ্ন আব্দুর রহিমের।
পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনে অপেক্ষমাণ রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। কাদা মাখা প্যান্ট। গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে আবার শুকিয়েছে বহুবার। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন। আর সেকেন্ডে সেকেন্ড উঁকি দিচ্ছেন ওয়ার্ডের দিকে। দরজার কাঁচ দিয়ে ভেতরে দেখছেন। কেননা, সেখানে ভর্তি রয়েছে তার আদরের শিশু সন্তান মুনতাহা তোয়া কর্ন (১০)। ৫ শতাংশ দগ্ধ হওয়ায় কর্ন তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। চিকিৎসকরা এমনটি নিশ্চিত করলেও মন মানছে না বাইরে অপেক্ষমাণ থাকা বাবা-মায়ের। তাই মেয়েকে এক নজর দেখার আশায়, পরম আদরে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপক্ষোয় প্রহর গুনছেন আবুল কালাম।
আবুল কালাম বলেন, যেখানে বিমান পড়েছে, ওই স্থানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আমার মেয়ে। বিমান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে দৌড় দেয়। তবে বিস্ফোরণের তাপ এসে লাগে দুই হাতে। কাঁধের স্কুল ব্যাগেও আগুন ধরে যায়। সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করে। এরপর কয়েক হাসপাতাল ঘুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে মেয়েকে দেখতে পাই। খুব ভয় পেয়েছে আমার মেয়েটা। সারারাতে ঘুমাতেও পারেনি। একটু দোয়া কইরেন আমার মেয়েটার জন্য।
শুধু সামিয়া আর কর্ন নয়; তাদের মতো বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকা ২৮ শিশুর মধ্যে অনেকের জীবন শঙ্কায় রয়েছে। ছোট্ট শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। তাদের বাবা-মা বাইরে অপেক্ষা করছেন, কিছুক্ষণ পর পর অনুমতি নিয়ে সন্তানের কাছে যাচ্ছেন। পরম যত্মে আদর করছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তোমার কিচ্ছু হবে না, সুস্থ হয়ে উঠবে। ২/১ দিন পরই আমরা তোমাকে এখান থেকে বাসায় নিয়ে যাব।’ এমন আশ্বস্ত করে বাইরে এসে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন অভিভাবকরা।
স্কুল ছুটির পর দৌড়ে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও এখন জীবন শঙ্কায় হাসপাতালের বিছানায় কোমলমতি শিশুরা। ইতোমধ্যে লাশ হয়ে মর্গ ঘুরে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে তাদের অনেক সহপাঠী। অভিভাবকদের আশঙ্কা, না জানি তার সন্তানেরও এমনটি হয়। না জানি অস্ফুট স্বরে বলা সন্তানের কথাটি সত্য হয়ে যায়।
চিকিৎসাধীন ২৮ শিশু ॥ বার্ন ইনস্টিটিউটের করা তালিকা অনুযায়ী সেখানে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে ২৮ জন শিশু। তারা হলোÑ মাহতাব (১৪) ৪৫ শতাংশ, এবি শামীম (১৪) ৯৫ শতাংশ, সায়মা (১০) ২৫ শতাংশ, মাহিয়া (১৫) ৫০ শতাংশ, নাফিজ (৯) ৯৫ শতাংশ, আফরান ফাইয়াজ (১৪) ৯৫ শতাংশ। এদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বাকিরা হলো- মুনতাহাব (১০) ৫ শতাংশ, রুপি বড়ুয়া (১০) ৬ শতাংশ, জায়ানা (১৩) ৮ শতাংশ, ইশা (১১) ৬ শতাংশ, পায়েল (১২) ১০ শতাংশ, তাসনিয়া (১০) ৫ শতাংশ, কাব্বো (১৩) ২০ শতাংশ, সায়েবা (৯), তৌফিক (১৩), আলভিরা (১০), নুসরাত (১২), জুনায়েদ (১২), শ্রেভা (৯), কাফি আহমেদ (১০), আয়াত (১৪), রোহান (১৪), আবিদুর রহমান (১০), আয়ন (১৪), আরিয়ান আফিফ (১২), মাকিন (১৫), সায়েমা (৯) ও মেহরিন (১১)।
অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক ॥ বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি দগ্ধদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং কোমলমতি শিশু। আর তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এখানে ভর্তি দগ্ধদের বেশিরভাগই শিশু। তাদের অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের একটি বিশেষ দল আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। সবাইকে সারিয়ে তুলতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিহত বেড়ে ৩১ ॥ ভয়াবহ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার পর হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের হালনাগাদ সংখ্যা প্রকাশ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে, আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে।
আইএসপিআর জানায়, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮ জন আহত, নিহত নেই। বার্ন ইনস্টিটিউটে রয়েছে ৪৬ জন আহত এবং ১০ জন নিহত। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আছে ৩ জন আহত এবং ১ জন নিহত হয়েছেন। ঢাকার সিএমএইচে রয়েছে ২৮ জন আহত এবং ১৬ জন নিহত। লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার, উত্তরায় ভর্তি আছে ১৩ জন আহত এবং ২ জন নিহত। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬০ জন আহত এবং ১ জন নিহত। উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রয়েছে ১ জন আহত, নিহত নেই। শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১ জন আহত। ইউনাইটেড হাসপাতালে আছেন ২ জন আহত এবং ১ জন নিহত এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রয়েছেন ৩ জন আহত।
বার্নে যে ৬ জন মারা গেলেন ॥ বার্ন ইনস্টিটিউটে সোমবার রাত ১২টার পর থেকে মঙ্গলবার বিভিন্ন সময়ে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫ জনই শিশু। নিহত ৬ হলেনÑ উত্তরা-১ নং সেক্টরের বাসিন্দা আবুল ফাতাহ মো. ইউসুফের ছেলে শায়ান ইউসুফ (১৪)। তার শরীরের ৯৫ দগ্ধ হয়েছে। মঙ্গলবার তার চাচা মো. হাবিব সরোয়ার লাশ গ্রহণ করেন। তুরাগ থানাধীন তারার টেকের মো. আবু শাহীনের ছেলে রোহান উদ্দিন বাপ্পী (৯)। তার দগ্ধ হয়েছে ৩৫ শতাংশ। একই এলাকার মো. সেলিম মিয়ার ছেলে আরিয়ান-১ (১২)। তার দগ্ধ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। রাজবাড়ীর আশরাফুল ইসলামের মেয়ে নাজিয়া (১৩)। তার দগ্ধ হয়েছে ৯০ শতাংশ। বান্দরবানের রামু উপজেলার উসাই মং মারমার ছেলে উক্য ছাই মারমা (১৪)। তার শরীরের শতভাগ পুড়ে গিয়েছিল। ৮৫ শতাংশ হওয়া শিক্ষিকা মাসুকা (৩৭)।
পুড়ে বিকৃত ৬ লাশ ॥ বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যাওয়া ৬ লাশের বিপরীতে ৪টি দাবিদার এসেছে। পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় মৃতদেহগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে বার্ন ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
এ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, বার্ন ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ৪৩ জন ভর্তি আছে। এদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা উন্নতি হওয়ায় বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ২ জন শিক্ষক। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া ৬ জনের মধ্যে ৪ জনের বিপরীতে দাবিদার এসেছে। তাদের ডিএনএ টেস্ট করে ম্যাচ হওয়ার পর লাশ হস্তান্তর করা হবে।
তবে এখনো ২টি লাশের দাবিদার আসেনি। মঙ্গলবার রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসকদের এক দল বাংলাদেশে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আসলে চিকিৎসায় কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করলে তারা করতে পারেন। এর আগে সকালে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ছিল ২৭ জন। এর মধ্যে ২৫ জন শিশু ছিল।