
ছবি: সংগৃহীত
ইংরেজি ক্যালেন্ডারে সেদিন ২১ জুলাই ২০২৫। রাজধানী উত্তরা তখন প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত আর স্বাভাবিক এক দুপুর পার করছিল। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের ছুটির ঘণ্টা বাজলো। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শেষে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনের মতো মিস'র দেওয়া হোমওয়ার্ক আর কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাসিমাখা মুখে প্রিয় মা-বাবার বুকে ফিরবে - ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশ থেকে যেন আগুন নেমে এলো।
বিকট বিস্ফোরণের শব্দ, আগুনের শিখা আর ধোঁয়ার কুন্ডলীতে মুহূর্তেই শিক্ষাঙ্গন রূপ নেয় এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান (BGI F-7BGI) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তরার সেক্টর-১১ এলাকার মাইলস্টোন কলেজ সংলগ্ন ভবনে বিধ্বস্ত হয়।
ঘটনার সময় ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগুনে দগ্ধ হন, কেউ কেউ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। পরবর্তীতে এখন পর্যন্ত হাতে পাওয়া সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং আহত হন প্রায় ১৭০ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গোটা দেশ এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর স্তব্ধ হয়ে যায়। শিক্ষাঙ্গনে প্রাণহানির এমন নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই বললেই চলে।
বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার কাজে ছুটে আসেন। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য উদ্ধারকারী সংস্থার সদস্যরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা করলেও আগুনের তীব্রতায় অনেক শিক্ষার্থী পালাতে পারেনি। স্কুল গেটের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া এক অভিভাবক বলছিলেন,'আমার ছেলে তো শুধু ক্লাসে গিয়েছিল, যুদ্ধ করতে তো যায়নি!' একটি মায়ের বুকফাটা কান্না আর একটি পিতার নির্বাক তাকিয়ে থাকা চোখের জল এনে দেয়।
দুর্ঘটনার সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে আনতে গিয়ে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন শিক্ষক মহেরিন চৌধুরী। আগুনের ভয়াবহতার মাঝেও তিনি প্রায় ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের করে আনেন। পরে তিনি নিজেও গুরুতর দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ জাতিগতভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটির পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। এটি ছিল তার প্রথম একক প্রশিক্ষণ ফ্লাইট। পাইলট শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং বিমানটিকে জনবহুল এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান। দুর্ঘটনার পর তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস দগ্ধদের সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে প্রশ্ন উঠেছে- এমন ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় কীভাবে বিমান প্রশিক্ষণ চলছিল? নির্ধারিত নিরাপদ আকাশপথ না মেনে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ চালানো হলো?
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এটা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের অব্যবস্থাপনার নগ্ন উদাহরণ। নিরাপত্তা ও পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতার কারণেই এ ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে। তারা মনে করেন, নিরাপত্তা বিষয়ক বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা ছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।
আজকের এই ঘটনায় শুধু নিরীহ কিছু প্রাণ ঝরে গেল না, বরং কেঁপে উঠেছে জাতির নিরাপত্তাবোধের ভিত। প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি আদৌ আমাদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলতে পেরেছি?
শোকের ভাষা কখনো যথেষ্ট হয় না, কিন্তু শোক যেন আর বারবার না ঘটে -সেটাই হওয়া উচিত আমাদের মূল অঙ্গীকার। মাইলস্টোনের ছেলেমেয়েরা আর ফিরে আসবে না, তবে রাষ্ট্র যদি চায়, তাদের রক্ত বৃথা যাবে না। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা, কার্যকর নীতিমালা এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
আজ শুধু শ্রদ্ধা নয়, প্রতিবাদও জরুরি। আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ নিরাপদ আকাশপথ ও নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন নিশ্চিত করতে হবে এখনই। নয়তো আগামীকাল হয়তো আবারও শুনবো- আরেকটি বিদ্যালয়ের আকাশ থেকে আগুন নেমে এসেছে।
আঁখি