
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পুনর্জাগরণ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ড্রোন শোর একটি উপস্থাপনা
বছর ঘুরে আবার এসেছে একইসঙ্গে দ্রোহের উত্তাপ ও রক্তে ভেজা জুলাই মাস। তাই জুলাই মানে শিকল ভাঙার গান, জুলাই মানে বীরত্বের গল্প, জুলাই মানে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের দুঃসাহসী প্রকাশ, জুলাই মানে বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে ধরা অকুতোভয় তরুণের দুরন্ত সাহস। সেই বাস্তবতায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতোই রাজনীতির বাঁক বদলের এক কালোত্তীর্ণ অধ্যায় চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান।
ছাত্র-জনতার সেই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথের আন্দোলনের সমান্তরালে সোচ্চার হয়েছিল শিল্পের ভুবন। রাজধানীর মূল সড়ক থেকে অলি-গলির দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল শিল্পিত প্রতিবাদের গ্রাফিতি। সেসব দেওয়ালচিত্র এখনো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এক বছর আগের উত্তাল দিনগুলোর কথা। সেই সময় রচিত হয়েছিল আন্দোলনকে তেজোদ্দীপ্ত করা অসংখ্য গান কবিতা। আন্দোলনে গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে আমনজতার সঙ্গে শিল্পী সমাজের অনেকেই হয়েছিলেন সোচ্চার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন পিচঢালা পথে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধে।
শিল্পিত সেই প্রতিবাদের পথরেখায় জুলাই আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উদ্যাপনে বর্তমানে দারুণ সরব শহর ঢাকার শিল্প-সংস্কতি ভুবন। চলছে সরকারি থেকে বেসরকারি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বহুমাত্রিক আয়োজন। গান-কবিতার আশ্রয়ে উচ্চারিত হচ্ছে দুর্বার সাহসের প্রতিচ্ছবিময় সময়ের কথা। মঞ্চে আসা নয়া নাটকের মাধ্যমে স্মরণ করা হচ্ছে সেই উত্তাল সময়কে। শুধু কি তাই! গ্যালারির প্রদর্শনী থেকে উন্মুক্ত আঙিনার রাতের আকাশ আলোকিত করা ড্রোন শোতেও উঠে আসছে জুলুমের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা গণঅভ্যুত্থানের নানা অধ্যায়।
জুলাই অভ্যুত্থান স্মৃতির পুনর্জাগরণ উপলক্ষে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সেই আয়োজনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি জুলাই উইমেন’স ডে উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়েছে হৃদয়স্পর্শী এক অনুষ্ঠান। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটির অন্যতম আকর্ষণ ছিল নয়নজুড়ানো মিউজিক্যাল ড্রোন শো। রাত দশটার পরে ভাষা শহীদদের স্মৃতিময় আঙিনায় আলোর খেলায় সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা।
রাতের অন্ধকার ভেদ করে অন্তরীক্ষে উড়ে বেড়িয়েছে আলোর মায়াবী ভুবন গড়া জুলাইয়ের গল্প বলা দুই হাজার ড্রোন। এসব ড্রোনের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় আন্দোলনের প্রাণসঞ্চারী দৃশ্যপট। আলোকরশ্মির সেই ক্যানভাসে দৃশ্যমান হয় ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মেয়েদের ¯্রােতের মতো বেরিয়ে এসে আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার স্মরণীয় মুহূর্ত।
ড্রোন শোর প্রথম ধাপে দেখানো হয় কীভাবে বাংলাদেশ জুলাইয়ে এসে পৌঁছাল। দ্বিতীয় ধাপে দেখানো হয় কেমন করে ১৪ তারিখে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জুলাইয়ের সূচনা হলো। এর মধ্যে একটি পরিবেশনায় আলোকময় দৃশ্যের সঙ্গে ভেসে ওঠে ‘শোনো মহাজন আমরা অনেকজন’ শিরোনামের লেখা। আরেকটি দৃশ্যচিত্রে আন্দোলনে জখম হওয়া এক নারী শিক্ষার্থীর অবয়বের ওপরে ভেসে বেড়ায় ‘জন্মভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক স্লোগান। আরেকটি দৃশ্যে আন্দোলনরত দুই শিক্ষার্থীর কাঠামোর সঙ্গে দৃশ্যমান হয় ‘আমার ভাই কবরে/খুনি কেন বাহিরে’ শীর্ষক স্লোগান। এভাবে গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষ্যবহ নানা মুহূর্ত কড়া নাড়ে দর্শকের উপলব্ধির জগতে। স্মৃতির আয়নায় ধরা দেয় অগ্নিগর্ভ সময়।
এই ড্রোন শোর বাইরে সাংস্কৃতিক পর্বে গানে গানে শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়েছেন খ্যাতিমান থেকে উদীয়মান শিল্পীরা। প্রদর্শিত হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মঞ্চে উচ্চারিত হয়েছে অভ্যুত্থানের জ্বালাময়ী স্লোগান। সঙ্গে ছিল শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ। এছাড়া মাসব্যাপী আয়োজনের অংশ হিসেবে গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে ১১টি নতুন মঞ্চনাটক এনেছে শিল্পী একাডেমি। ইতোমধ্যে কয়েকটির নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়েছে। আগামী আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত একাডমির নাট্যশালায় বাকি নাটকগুলোর প্রদর্শনী হবে।
এদিকে পান্থপথের দৃক গ্যালারিতে চলছে গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। এ আয়োজনের শিরোনাম ‘বুক পেতেছি, গুলি করÑ আবু সাঈদ হত্যার পাল্টা ফরেনসিক তদন্ত’। আলোকচিত্র, আবু সাঈদের ফেসবুক স্ট্যাটাস, তার প্রাণ কেড়ে নেওয়া কার্তুজসহ নানা অনুষঙ্গে সেজেছে এই প্রদর্শনী। এই পাল্টা ফরেনসিক তদন্তের মধ্য দিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী আবু সাঈদের মর্মান্তিক হত্যাকা-কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যিনি ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে নিহত হন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই কোটা সংস্কার আন্দোলন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটায়।
প্রাথমিকভাবে সরকারি বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছিল যে, আবু সাঈদ বিক্ষোভকারীদের ছোড়া পাথর এবং আগ্নেয়াস্ত্রে প্রাণ হারান। তবে বাংলাদেশের দৃক পিকচার লাইব্রেরি এবং যুক্তরাজ্যের ফরেনসিক আর্কিটেকচার দ্বারা পরিচালিত পাল্টা ফরেনসিক তদন্ত একেবারে ভিন্নচিত্র সামনে নিয়ে এসেছে। এই তদন্তে বিভিন্ন বিশদ সাক্ষাৎকার, ফটোগ্রামেট্রি, হিট ম্যাপ, স্যাটেলাইট চিত্র এবং ছবি ও ভিডিওসংবলিত প্রমাণ ব্যবহার করে সরকারি বয়ানের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। শিল্পিত এই তদন্ত পুলিশের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভূমিকা এবং অতিরিক্ত শক্তির ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়, যা বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহিংসতার অভিযোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
প্যানেল হু