ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকা
ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আগামী তিনদিনও মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এর মাঝে আরও একটি দুঃসংবাদ জানাল তারা।
তাদের তথ্য, বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি সতর্কসীমায় পৌঁছে যেতে পারে। এতে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানিও সতর্কসীমায় চলে যেতে পারে। এতে সিলেটের নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবার আশঙ্কা রয়েছে। বিভাগের অন্য নদী যেমন সারিগোয়াইন, মনু, ধলাই, খোয়াই নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের হালদা ও গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে গত ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। আগামী একদিনও এমন বৃষ্টিপাত হতে পারে।
ফেনী ॥ টানা বৃষ্টি ও পাহাডি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২০টি স্থান ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৩ উপজেলার ১১৪টি গ্রাম। বুধবার দুপুর থেকে বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। ৩টি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভাঙন স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করছে ছাগলনাইয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। একাধিক সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। এতে দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। উজানের পানি নামতে থাকায় ছাগলনাইয়ার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে ৪৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যাদুর্গত ৬ হাজার ৮২৬ জন অবস্থান করছেন। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইতোমধ্যে ৯০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছে। ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিয়নের উত্তর সতর গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এখান দিয়ে মুহুরী নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। এবারও উপজেলার মাটিয়াগোধা, দক্ষিণ সতর নদীরকূল, দক্ষিণ সতর, উত্তর পানুয়া, কাশিপুর, নিচিন্তা, লক্ষ্মীপুরসহ ১০টিরও বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। পাঠাননগর এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী বলেন, পরশুরাম-ফুলগাজীর ভাঙন স্থান দিয়ে আসা পানিতে ছাগলনাইয়া উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে যানচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পানির চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ফেনী সদর উপজেলাতেও পানি প্রবেশ করার আশঙ্কা রয়েছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান জানান, জেলায় টানা তিনদিন ধরে মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবারও জেলাজুড়ে হালকা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানি কমলেও ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি কমার পরেই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবল চাকমা বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে দুর্গত মানুষের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। উপজেলায় ৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে।
এ ব্যাপারে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে প্রায় ২০ হাজার মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পরশুরামে ২৭টি, ফুলগাজী ৬৭টি, ছাগলনাইয়া ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায ত্রাণ সহায়তা করেছে বিজিবি। পরশুরামে বিজিবির পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার বিতরণ ও বন্যার্তদের উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্গত এলাকায় উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম করে যাচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হচ্ছে। শুকনা খাবার ও নিরাপদ পানির সংকটে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের জন্য প্রতিবছর এ জনপদে নদীর বাঁধ ভাঙন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর বন্যায় ঘরবাড়ি, ফসল হারানো মানুষের দুর্ভোগ যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকাবাসী ত্রাণ সহযোগিতা চায় না, চায় তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণের ।
খাগড়াছড়ি ॥ দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এখনো টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। মাইনী নদীর পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোট মেরুং বাজার এলাকা, সোবহানপুর, চিটাগাংপাড়া, কবাখালীসহ আশপাশের গ্রামগুলো এখনো প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে।
বন্যার কারণে দীঘিনালা-লংগদু সড়কের স্টিলব্রিজ এলাকায় সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গত দুইদিন ধরে রাঙ্গামাটির লংগদুর সঙ্গে দীঘিনালার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা।
কুমিল্লা ॥ টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। ফলে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও ফসলি চর প্লাবিত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে গোমতী নদীর পানির লেভেল দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৮ মিটার, যা বিপৎসীমার মাত্র ১ দশমিক ৬৮ মিটার নিচে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় ৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে লাগাতার বৃষ্টির কারণে উজান থেকে পানি আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ভারতে বৃষ্টি কিছুটা কমায় স্রোতের তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
কুমিল্লা বিভাগের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালীউজ্জামান বলেন, গোমতী নদীর বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩০ মিটার। বর্তমানে তা ৯ দশমিক ৬৮ মিটারে রয়েছে। অর্থাৎ এখনো প্রায় দেড় মিটার নিচে। বৃষ্টি কমলে এবং উজানের ঢল বন্ধ হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তবে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুত আছি।
ভোলা ॥ মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা ৭ দিন ধরে দ্বীপজেলা ভোলায় বৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা। অতি বৃষ্টির কারণে ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের বীজতলা। ভেসে গেছে বহু পুকুরের মাছ। এতে করে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে করে চাষিরা দুঃচিন্তায় পড়েছেন।
স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্রে ৩ নম্বর সর্তক সংকেত থাকায় গত এক সপ্তাহ ভোলায় টানা মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।
বাগেরহাট ॥ গত ৪ দিনের টানা বৃষ্টিতে বাগেরহাট শহরের সড়ক থেকে গলি, বাড়ি থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম দৃশ্যত তলিয়ে গেছে। এমনকি জেলা শহর বাগেরহাট পৌরসভার অধিকাংশ এলাকায় হাঁটুপানি জমেছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। পানিবন্দি মানবেতর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্লাবিত হয়েছে। অসংখ্য চিংড়িঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অতিরিক্ত পানির চাপ ও লাগাতার বৃষ্টিতে বেমরতার চিতলী এলাকায় ভৈরব নদের বাঁধ ভেঙে গেছে।
প্যানেল মজি