
রমনা পার্কের শিশু কর্নারের রাইডে চড়ে বৃহস্পতিবার আনন্দ উৎসবে মেতেছে সোনামণিরা
শহর ঢাকার চিরাচরিত দৃশ্য যানজট ও জনজট। যান্ত্রিক এই নগরীতে বসবাসের সুবিধার উল্টোপিঠে রয়েছে বহুমুখী বিড়ম্বনা। এখানে অট্টালিকার ভিড়ে হারিয়ে যায় আকাশ। গাড়ির কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় নাক-মুখ ঢেকে পথ চলতে হয় নাগরিকদের। গাড়িচালকদের অযথা হর্ন বাজানোর কারণে তালা লেগে যায় কানে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে- কেমন কেটেছে শহর ঢাকার গেল সপ্তাহের দিনরাত্রি? এর উত্তরে বলা যায়, বিশ্রামে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।
এ যেন অনেকদিন পর মিলে যাওয়া অবসর। এখনো খোলেনি অফিস-আদালত। বন্ধ রয়েছে বহুতল শপিং মল থেকে ছোট-বড় বিপণি বিতানসমূহ। এমনকি ফুটপাতের চা, বিড়ি, পান-সিগারেট থেকে পোশাক কিংবা খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোও অনেকাংশ বন্ধ রয়েছে। তাই ব্যস্ততম নগরীতে চোখে পড়ছে না মানুষের কর্মব্যস্ততা। সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারেও প্রধান প্রধান সড়কে ছিল না যানবাহনের চাপ। ঈদুল আজহার লম্বা ছুটির কারণে এভাবেই ভিন্ন এক আবহ বিরাজ করছে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির এই শহরে।
আর সেই ভিন্ন আবহে শত রঙের ফোয়ারা বইছে রাজধানীতে। নগরবাসী উপভোগ করছেন দারুণ এক সময়। কারণ, আক্ষরিকভাবে তিনদিনের ঈদ উৎসব শেষ হলেও রয়ে গেছে তার রেশ। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্য বয়স থেকে বয়োবৃদ্ধ সবার মনে খুশির জোয়ার। ফাঁকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছেন বিনোদনপিপাসু নগরবাসী। উল্টোদিকে আবার ঈদ আনন্দে নীরব শহরও সরব হয়েছে বিনোদনপ্রেমীদের মুখরতায়। তাই বলে সেটা কর্র্কশ গর্জনে বিরক্তির কারণ হয়নি।
যানবাহনের চাপ না থাকায় ট্রাফিক জ্যামহীন শহরে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরবাসী। চলছে শহরবাসীর ছোটাছুটি। ফাঁকা হওয়া শহরে ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে চলেছে রিক্সাভ্রমণ। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছানো গেছে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। ফলশ্রুতিতে ঘোরাঘুরি হয়েছে আরামদায়ক ও স্বস্তিকর। সবুজে শোভিত রমনা পার্ক থেকে রুপালি পর্দার সিনেমা হল, মুঘল স্থাপনা লালবাগ কেল্লা থেকে চিড়িয়াখানা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, হাতিরঝিল, বিভিন্ন থিম পার্ক, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থান ঘুরে কেটে যাচ্ছে সুন্দরতম সময়। সেই সুবাদে ঈদ উৎসব উদ্্যাপনে নগরবাসীর সরব পদচারণায় রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলো পরিণত হয়েছে জনারণ্যে।
রাজধানী ঢাকায় এখন রয়েছে অগণন বিনোদন কেন্দ্র। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এখনো সবচেয়ে বেশি মানুষকে কাছে টানে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। তাই এবারও ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমেছে এই প্রাণিরাজ্যে। চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার জনকণ্ঠকে জানান, মূলত ঈদের দ্বিতীয় দিন রবিরার থেকে দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটছে সেখানে। সোমবার সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শনার্থী প্রবেশ করেন চিড়িয়াখানায়।
ঈদের ষষ্ঠদিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল সেই স্রোতধারা। এই ছয়দিনে চার লক্ষাধিক মানুষ ঢুঁ মেরেছে প্রিয় প্রাঙ্গণে। তাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সময় কেটেছে নানা জাতের পশু-পাখি দেখে। মন ভরে উপভোগ করেছে বাঘের গর্জন, বানরের চেঁচামেচি, বেবুনের ভেংচি কাটা, উটপাখির দৌড়াদৌড়ি, জলহস্তির ডুবসাঁতার, ময়ূরের নাচ, নানা জাতের সাপের ধীরগতিতে পথচলা, আর কত কি।
সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে বানরের খাঁচার সামনে। কারণ অন্য প্রাণী চিড়িয়াখানায় আসার পর তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য সামান্য হলেও হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বানরের বাঁদরামি এখানে বিন্দুমাত্র কমে না। তারা সব সময়ই প্রাণবন্ত থাকে ও সারাক্ষণ খাঁচার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত লাফালাফি করতে থাকে। শিশু-কিশোররাও অনেক সময় যোগ দেয় তাদের বাঁদরামির সঙ্গে। অনেকেই শিশু-কিশোরসহ পরিবারের বিভিন্ন বয়সী সদস্যদের নিয়ে দিনভর মজার সময় কাটিয়েছেন পশুপাখি দেখে।
ঢাকাবাসীর জন্য এক নির্মল আনন্দের উৎস রমনা পার্ক। ৬৮ একরের এই বিশাল উদ্যানের রকমারি প্রজাতির বৃক্ষ থেকে পুষ্পের সৌন্দর্য অভিভূত করে ছোট থেকে বড় সকলকে। এগুলোর মধ্যে আছে বিরল প্রজাতির গাছ। সঙ্গে থাকে মন উচাটন করা পাখির কলকাকলি। নয়নে প্রশান্তি ছড়িয়ে চারপাশে বৃক্ষরাজিকে ঘিরে থাকা আট একরের বৃহৎ লেকটি। সে কারণেই ঈদ উৎসবকে ঘিরে প্রতিদিনই সরব থেকেছে সবুজ-শ্যামলে আবৃত উদ্যান। সেই সূত্রে বৃহস্পতিবার বিকেলেও প্রচুর দর্শনার্থীর দেখা মেলে। এর মধ্যে শিশু চত্বরের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে অভিভাবককে সঙ্গী করে নানা রাইডে চড়ে সুন্দরতম সময় পার করেছে সোনামণিরা।
ঈদ ছুটিতে ফাঁকা রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক আনন্দপিপাসুর ভিড় জমেছিল হাতিরঝিলে। কেউ যুগলবন্দি হয়ে পরস্পরের হাত ধরে, কেউ পরিবারের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে হাতিরঝিল। বিভিন্ন বাহনে চড়ে চলেছে এই ঘোরাঘুরি। তাদের অনেকেই আবার হাতিরঝিলে অবস্থানরত চক্রাকার বাস ও ওয়াটার বাসে ভ্রমণ করে সময় কাটিয়েছেন।
ঘোরাঘুরির তালিকায় বাদ যায়নি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, জিয়া উদ্যানসহ সংসদ ভবন এলাকার চারপাশ, সামরিক জাদুঘর, নভোথিয়েটার, বিমানবাহিনী জাদুঘর, পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্পট। কেউবা ঢুঁ মেরেছেন রাজধানীর উপকণ্ঠ শ্যামপুরে গড়ে ওঠা শ্যামপুর বুড়িগঙ্গা ইকোপার্কে। ঢাকার অদূরে ফ্যান্টাসি কিংডম বা নন্দন পার্কেও রকমারি রাইডে চড়ে উৎসব উদ্্যাপন করেছেন অনেকে। এই তালিকায় বাদ পড়েনি ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকায় সাজানো হেরিটেজ পার্কও।
অন্যদিকে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারা, উত্তরায় গড়ে ওঠা ইনডোর রেস্তোরাঁগুলো দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত জমজমাট ছিল বিনোদনপিপাসুদের আনাগোনায়। মধুমিতা, স্টার সিনেপ্লেক্স, বলাকা কিংবা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবি দেখেও আনন্দ উপভোগ করেছেন অনেক সিনেমাপ্রেমী।