
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চর হাবিব, লতাচাপলী, সোনাতলা, কাউয়ারচর, হাজীপুর ও চর খাজুরার পাঁচ হাজার একর চর/খাস জমি ‘সংরক্ষিত বন এলাকা’ ঘোষনার ইস্তেহার জারির ৩৯ বছর পরও কার্যকর হয়নি। ফলে এসব চরের ভুমিতে প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত ম্যানগ্রোভসহ বিভিন্ন বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। নদী তীরের চরে সৃজিত এই বনাঞ্চল এক শ্রেণির ভূমিদস্যু নিজেদের দখলে নিয়ে বাড়ি-ঘর চাষের জমি বানাচ্ছে। কেউবা ইটভাঁটি কিংবা মাছের ঘের করছে। করা হয়েছে করাতকল। বহু জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল পর্যন্ত উজাড় হয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে এসব সরকারি চর কিংবা খাস জমি বেহাত হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বনবিভাগ এবং স্থানীয় ভূমি প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারনে নদী তীরের সরকারি চর কিংবা খাস জমি স্থায়ীভাবে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা না করে নদীসহ নদী তীরের জমি ভূমি অফিসের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ চক্রের যোগসাজশে ভূমি দস্যুরা উল্টো চাষযোগ্য খাস জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত নিয়ে নেয়। ২০-২৫ বছর আগে পুরো নদীকে এভাবে বন্দোবস্ত নিয়ে এখন চর জেগে ওঠায় চরের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলসহ দখল করে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ফলে একদিকে নদী দখল হচ্ছে অপরদিকে প্রাকৃতিকভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।উপকলীয় মানুষের ঝড়-ঝঞ্ঝাকালীন জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এসব চরে সৃষ্ট ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য। সিডর, আইলাসহ বড় ধরনের সাইক্লোনের জলোচ্ছ্বাস বাধাগ্রস্ত করছে এই বনাঞ্চল। একারণে সরকার জেগে ওঠা চরকে বনবিভাগের হাতে ন্যস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে (এস, এ, শাখা) ১৯৮৬ সালের ১১ জুলাই সরকারি বিজ্ঞপ্তি নম্বর ১২/ফর-১-১৪/৪৮/২৩ অনুসারে ১৯২৭ সালের বন আইনের (১৯২৭ সালের ১৬ নং আইন) অধীনে উপরোক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কলাপাড়ার বিভিন্ন চরাঞ্চলের পাঁচ হাজার একর চর/খাস ভূমি “ সংরক্ষিত বন এলাকা” ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা কার্যকর না হওয়ায় ফের ২০০৪ সালের ১১ মার্চ জেলা প্রশাসকের এসএ শাখার ৪৫৫ নম্বর ইস্তেহারে এই পরিমান বনভূমি ‘সংরক্ষিত বন এলাকা’ ঘোষণা কার্যকরের নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই নির্দেশের আলোকে সবশেষ ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি কলাপাড়ার তৎকালীন বন কর্মকর্তা মোঃ ফয়েজুর রহমান এক চিঠিতে কলাপাড়ার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এ পরিমান বনভূমি যেন কাউকে বন্দোবস্ত দেয়া না হয় এমন অনুরোধপত্র দিয়েছেন। কিন্তু এ সংরক্ষিত বন এলাকা চিহ্নিত তো দূরের কথা, ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারসহ এক শ্রেণির কর্মী এবং স্থানীয় দালালরা জেগে ওঠা চরকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়। মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মধুখালী ভাড়ানি শাখা নদীর দুই পাড়ের চরের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এভাবে অনেককে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। একইভাবে টিয়াখালী নদীর তীরের চরভূমির বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি আন্ধারমানিক ও আরপাঙ্গাশিয়া নদী তীরের জমি। এসব নদী তীরে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা-কেওড়াসহ বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চলে ঘেরা রয়েছে। যা এখন বিলীনের শঙ্কা রয়েছে। নদী তীরসহ ওই চরাঞ্চল ‘সংরক্ষিত বন এলাকা’ ঘোষণা করলে একদিকে নদী তীর রক্ষা হতো। অপরদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পরিপূর্ণ থাকতো সকল নদী তীরের প্লাবনভূমি।
কিন্তু সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা না হওয়ার সুযোগে এখন নদীর পাশাপাশি নদী তীরের প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এসব কেটে সাফ করে এক শ্রেণির মানুষ বাড়িঘর, মাছের ঘের করলেও বনবিভাগ তাদের সংরক্ষিত বন নয়-এমন অজুহাতে রক্ষায় এগিয়ে আসে না। এই সুযোগে নদী তীরের ওইসব গাছ কেটে কেউ বাড়িঘর, কেউ চাষের জমি, কেউ মাছের ঘের করেছে। ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী তীরের চরভূমি বনবিভাগকে হস্তান্তর না করায় অধিকাংশ বেহাত হয়ে গেছে। সব কয়টি চরাঞ্চলে এই প্রক্রিয়া বর্তমানে চলছে ফ্রি-স্টাইলে। ফলে সংরক্ষিত বন এলাকা নিশ্চিহ্নের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।এমনকি ২০০৪ সালের ১১ মার্চে পটুয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসার শেখ মোঃ কাবেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ইস্তেহারে কলাপাড়া উপজেলার চর হাবিবের দেড় হাজার একর, লতাচাপলী মৌজার ১৬০০ একর, সোনাতলা মৌজার ৫০০ একর, কাউয়ার চরের ৬০০ একর, হাজিপুরের ৩০০ একর, চরখাজুরার এক হাজার একর এবং ধুলাসারের ৫০০ একর চর/খাস জমি সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। শুধু তাই নয় গোটা পটুয়াখালী জেলায় ৪৩টি মৌজার চরাঞ্চলের ৪৭ হাজার ৯৫২ একর চর/খাস জমি সংরক্ষিত বন এলাকা চিহ্নিত করা হয়। যা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। বর্তমানে নতুন করে প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত সোনাতলা ও আরপাঙ্গাশিয়া নদী তীরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বিশাল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলও নিশ্চিহ্নের ঝুঁকিতে রয়েছে।
কারণ আশপাশের মৌজার ওইসব চরের জমিতে বাড়িঘর, চাষের জমি, মাছের ঘের তৈরি করা এবং দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ফলে উপকূলীয় বনভূমির পরিমান বৃদ্ধি পায়নি। সরকারি এ ইস্তেহার যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় পরিবেশ প্রতিবেশ হুমকির কবলে পড়েছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে সরকারের শত শত কোটি টাকার চর/খাস ভূমি। বনবিভাগ মহীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা এ বিষয় কোন অগ্রগতি তো দূরের কথা কোন তথ্য দিতে পারেননি। ফলে বনভূমি সৃজন কিংবা নতুন জেগে ওঠা চর/খাস ভূমি রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল নিশ্চিহ্নের ঝুঁকিতে রয়েছে। পরিবেশ সংগঠক নজরুল ইসলাম জানান, নদীর সীমানা চিহ্নিত করে বনাঞ্চলসহ সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণার জরুরি বাস্তবায়ন করা দরকার। নইলে কলাপাড়ার পরিবেশ প্রতিবেশ জীববৈচিত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
রাজু