ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাফারি পার্কে ৩ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে টেন্ডার জালিয়াতি, গোপন মূল্য ফাঁস

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৫ মে ২০২৫; আপডেট: ২৩:৩৯, ২৫ মে ২০২৫

সাফারি পার্কে ৩ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে টেন্ডার জালিয়াতি, গোপন মূল্য ফাঁস

ছবি:সংগৃহীত

চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ছয়টি অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে নজিরবিহীন টেন্ডার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সরকারি গোপন মূল্য ফাঁস হওয়ায় সুবিধা পেয়েছেন বন কর্মকর্তাদের মনোনীত ঠিকাদাররা।

সূত্র জানায়, ডিএফও কার্যালয়ে টেন্ডার কমিটির কাছে থাকা সরকারি গোপন মূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে দরপত্রের মূল্য মিলিয়ে কয়েকজন ঠিকাদার সিন্ডিকেট করে টেন্ডারে অংশ নেন। চলতি মাসের ৫ মে তারিখে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ৬টি উন্নয়ন কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন ছয়টি ভাগ্যবান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনায় টেন্ডারে অংশ নিয়ে অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে উন্নয়ন কাজ থেকে বঞ্চিত অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

তাঁরা জানিয়েছেন, এখানে ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য বসানো হয়নি। এ অবস্থায় সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জালিয়াতির ঘটনাটি তদন্ত করে এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের দাবি জানিয়েছেন তারা।

অভিযোগ উঠেছে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ তাঁর কার্যালয়ের অধস্তন কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের লেনদেনের বিনিময়ে সরকারি গোপন টেন্ডার মূল্য তাঁর পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের কাছে আগেভাগে ফাঁস করে দেওয়ায় এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডারে প্রতিযোগিতাহীন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

গত মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ টেন্ডার আহ্বান করেন।

চলতি মাসের ৫ মে দুপুর ১২টায় দরপত্র জমাদান ও খোলার শেষ সময় ছিল। ওইদিন ৬টি উন্নয়ন কাজের বিপরীতে নির্বাচিত ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, প্যাকেজ নম্বর ২০২৪/২০২৫/ডব্লিউপি/০১ টেন্ডারের বিপরীতে বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট নির্মাণ কাজটি ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকায় পেয়েছেন মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স। দরপত্রে ওই কাজের সরকারি মূল্য ছিল ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ টাকা।

টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান তথা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও’র উপর অর্পিত ক্ষমতাবলে সরকারি মূল্যের ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা। কাকতালীয়ভাবে ঠিক এই মূল্যেই দরপত্র দাখিল করে মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স কাজটি পেয়ে যান। অথচ ওই কাজটি পেতে টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল মোট ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তাদের মধ্যে মুজাহিদ ফাউন্ডেশন ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৯ টাকা ৪২১ পয়সা, মাছুম বিল্ডার্স ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা, নজরুল কনস্ট্রাকশন ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা ৯০০ পয়সা, রহিমা এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮১ টাকা ৯০০ পয়সা, বিসমিল্লাহ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৫ টাকা ৫৫০ পয়সা, রূপকার ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ১০৪ টাকা ৫৩৪ পয়সা, জিয়া এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৭ টাকা ৬৭০ পয়সা, আরএন এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭ টাকা ৮৭০ পয়সা, আবুল হাশেম ভূঁইয়া ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৯৯ টাকা ৪৫৩ পয়সা এবং দি এডি কনস্ট্রাকশন ৩৯ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্য উল্লেখ করে দরপত্র দাখিল করেন।

এখানেই শেষ নয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি টেন্ডারে ৮–১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও ডিএফও কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে মোট ছয়টি উন্নয়ন কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন ৬টি প্রতিষ্ঠান।

মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ছাড়াও এভাবে কাজ পেয়েছেন মেসার্স করিম অ্যান্ড ব্রাদার্স– ১ কোটি ৬৬ লাখ ৩১ হাজার ০০১ টাকায় কিপার গ্যালারি নির্মাণ কাজ, এডি কনস্ট্রাকশন– ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬৯ টাকায় এক্সচেঞ্জ রোড নেটওয়ার্ক এবং গেট নির্মাণ, রহিমা এন্টারপ্রাইজ– ২২ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৬ টাকা ৫০ পয়সায় বন্যপ্রাণীর খাদ্য সরবরাহ ঘর নির্মাণ, ফ্রেন্ডস ইঞ্জিনিয়ারিং– ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ২২৩ টাকা ৪০ পয়সায় প্রাণীর ঘর নির্মাণ এবং মুজাহিদ ফাউন্ডেশন– ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৮ টাকা ৫০ পয়সায় ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ কাজ।

অভিযোগ রয়েছে, এই টেন্ডার জালিয়াতিতে ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন টেন্ডার কমিটির সভাপতি বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা বেগম নূর জাহান, অপর কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য এবং কার্যালয়ের পুরোনো স্টাফ আরিফ আহমেদ।

বর্তমানে কাজ ভাগিয়ে নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টরা প্রতিদিন চট্টগ্রামে বিভাগীয় বনকর্মকর্তার কার্যালয়ে কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছেন। পুরোনো স্টাফ আরিফ আহমেদের আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদারদের কাজের ওয়ার্ক অর্ডার এনে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এবং ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ হোয়াটসঅ্যাপে জানান, “টেন্ডার জালিয়াতির কোন ঘটনা এখানে ঘটেনি। আমি বাঁশখালী বনাঞ্চলে আছি। নেটওয়ার্ক সমস্যা আছে, ধন্যবাদ।” পরে অবশ্য তিনি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করেননি।

মারিয়া

×