ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুরে ‘অহিমায়িত মডেল ঘরে’ আশার আলো দেখছেন আলুচাষিরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর

প্রকাশিত: ২০:০৭, ১৯ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ২০:১৯, ১৯ মার্চ ২০২৩

রংপুরে ‘অহিমায়িত মডেল ঘরে’ আশার আলো দেখছেন আলুচাষিরা

অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন করা হচ্ছে।

আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণনে অহিমায়িত মডেল ঘরে আশার আলো দেখছেন চাষিরা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, মডেল এই ঘরে ২৫-৩০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণে কৃষকের বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় দেড় লাখ টাকা। আর একেকটি অহিমায়িত মডেল ঘর ১২-১৫ বছর ব্যবহার করা গেলে দেড় কোটি টাকারও বেশি কোল্ড স্টোরেজ খরচ বাঁচবে, সঙ্গে কমবে আলু সংরক্ষণের বিড়ম্বনা।

রবিবার (১৯ মার্চ) দুপুরে রংপুর জেলার পীরগাছার কল্যাণী ইউনিয়নের স্বচাষে আনুষ্ঠানিকভাবে অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উদ্বোধনী কার্যক্রমে নতুন এই ঘরে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি তুলে ধরে কৃষকদের আশার কথা শোনান কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কৃষি কর্মকর্তারা। 


কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানায়, আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রংপুর বিভাগসহ দেশের ১৬টি জেলায় ৪৫০টি অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় হবে ২৮৩টি অহিমায়িত মডেল ঘর। চলতি অর্থ বছরে রংপুর জেলায় ৭৫টি অহিমায়িত মডেল ঘরের মধ্যে ৪৫টিতে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ২৫-৩০ মেট্রিকটন আলু ৪-৬ মাস ধরে সংরক্ষণ করা যাবে। সরকারি অর্থায়নে নির্মিত এসব অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বর্তমানে এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এর সুফল মিললে সারা দেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দেয়া হবে।  

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপহার পাওয়া মডেল ঘর পেয়ে আনন্দিত স্বচাষ গ্রামের স্থানীয় কৃষক বিপণন দলের সভাপতি আলুচাষি তৈয়বুর রহমান। তিনি জানান, আমরা আলুচাষিরা ন্যায্যমূল্য পাই না। প্রতিবছর আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছি। সার, বীজ, শ্রমিক, উৎপাদন খরচ ছাড়াও কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ খরচের কারণে নুমাফা নিয়ে হিশমিশ খেতে হয়।

তিনি বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেয়া অহিমায়িত মডেল ঘরে আমরা এখন ২৫-৩০ মেট্রিক টনের বেশি আলু রাখতে পারব। এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত মিনি কোল্ড স্টোরেজ। এতে আমাদের এই ঘর থেকে হিমাগারের তুলনায় দেড় লাখ টাকা সাশ্রয় হবে। বিশেষ করে আলুর দাম বাড়লে চাহিদা অনুযায়ী আমাদের ইচ্ছেমতো আলু বিক্রয় করতে পারব। সরকারের এই উদ্যোগ প্রতিটি কৃষকের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে অভিমত এই চাষির।

রংপুর জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র বিপণন কর্মকর্তা রবিউল হাসান বলেন, চাষিদের আলু সংরক্ষণের খরচ লাঘবে আমরা অহিমায়িত এই মডেল ঘরের পাইলট প্রোগ্রাম গত বছর থেকে হাতে নিয়েছি। সেই প্রোগ্রামের আজ বাস্তব রুপ পেতে শুরু করেছে। আমাদের এই একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে দেড় লাখ টাকা এর বিপরীতে কৃষক ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে নিশ্চিন্তে আলু সংরক্ষণ করতে পারবে। একেকটি ঘরে প্রায় ২৫-৩০ মেট্রিক টন আলু ৪-৬ মাস সংরক্ষণ করা যাবে। এতে প্রতি বছরে একেকজন আলুচাষির দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা হিমাগার খরচ সাশ্রয় হবে। 

আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আনোয়ারুল হক বলেন, সাধারণ কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতে প্রতি কেজিতে ৬ টাকা এবং অন্যান্য খরচ মিলে কেজিতে ১০ টাকা দাঁড়াবে। কিন্তু অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণে কোনো খরচ নেই। কৃষকের যদি হিমাগারের খরচ বেচে যায়, তাহলে তারা ১৫-১৬ কেজিতে আলু বিক্রি করলে অনেক বেশি লাভবান হবে। এই মিনি অহিমায়িত মডেল ঘরে জুন পর্যন্ত আলু রাখতে পারলেও দাম নিয়ে চাষিদের চিন্তা করতে হবে না। কারণ, তারা নিজেদের ইচ্ছে মত আলু বিক্রি করতে পাবে।

এ দিকে স্বচাষ গ্রামে আলুচাষি তৈয়বুর রহমানের বাড়ির পাশে এক শতাংশেরও কম জমির উপর নির্মাণ করা হয়েছে অহিমায়িত মডেল ঘর। সম্পূর্ণ দেশীয় সনাতন পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্মিত এই মডেল ঘরে কৃষকেরা আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন। এই সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের দোড় গোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

প্রান্তিক পর্যায়ের আলুচাষিরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে নির্মিত অহিমায়িত মডেল ঘরের সুবিধা নিশ্চিতে তদারকি বাড়াতে হবে। সঙ্গে স্বল্প সুদে সরকারি ঋণ সহায়তা পেলে তারা নিজেরাই ব্যক্তি উদ্যোগেও এ ধরণের অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণ করে সেখানে আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন। এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা গেলে কোল্ড স্টোরেজে আলু সংক্ষরণের জটিলতা, বাড়তি ব্যয় ও বিড়ম্বনা থেকে যেমন স্বস্তি মিলবে, তেমনি সংরক্ষণ খরচ কম হওয়াতে লোকসানের ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।

রবিবার স্বচাষ গ্রামে অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ কার্যাক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার। তিনি আলু সংরক্ষণের পদ্ধতি সম্পর্কে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগাতে উন্নত জাতের আলু চাষে পরামর্শ দেন।

কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, রংপুর অঞ্চলে চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন অনেক বেশি। আমি নিজেই বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি বাড়ি এবং খেতে আলু, উপচে পড়ে আছে। সংরক্ষণের জায়গা নেই, আবার কেউ চাইলেও সহজে কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতে পারছেন না। কারণ, কোল্ড স্টোরেজেও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এ পরিস্থিতিতে অহিমায়িত মডেল ঘর আলু সংরক্ষণে একটি উত্তম ব্যবস্থাপনা।

তিনি বলেন, এই ঘর নির্মাণ করতে খুব বেশি খরচ লাগছে না। এটা আমরা পাইলট প্রকল্প হিসেবে নিয়েছি। কৃষকেরা চাইলে নিজেরাও ব্যক্তি উদ্যোগে আলু সংরক্ষণে এ ধরণের ঘর নির্মাণ করতে পারবেন। কারণ, এটি বিজ্ঞানসম্মত সহজ প্রযুক্তি এবং সস্তাসুলভ। এর সুফলে যদি কৃষকেরা উপকৃত হন, তাহলে আমরা সারা দেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দিব। মডেল এই ঘরে আলু সংরক্ষণ করলে আলুর রপ্তানি মূল্য কমে না। কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতে অনেক সময় আলু মিষ্টি হয়ে যায়, কিন্তু এই ঘরে সেই সুযোগ নেই। অহেতুক পোকামাকড়ের আক্রমণ, পচন ধরা ও গন্ধও ছড়াবে না। 

বিশ্বের ২৮টি দেশে আলু রপ্তানি হচ্ছে জানিয়ে ওয়াহিদা আক্তার বলেন, সানসাইন আলুর একটি নতুন জাত, রপ্তানিতে এই জাতের আলুর চাহিদা বেশি। আমরা রপ্তানি করা যাবে এমন আলুর উৎপাদন বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছি। কারণ, উন্নত জাতের এবং মানসম্মত আলু ছাড়া বাহিরের দেশগুলো আলু নিতে আগ্রহী নয়। মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের আলু রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমাদের লক্ষ্য রাশিয়ার বড় বাজার ধরা। সেখানে রপ্তানি বাড়াতে আমরা চেষ্টা করছি। 

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এর রিপ্রেজেন্টিভ ইন বাংলাদেশ রবার্ট ডি সিস্পাসণ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ বাদল বিশ্বাস চন্দ্র, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওমর মো. ইমরুল মহসিন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আফতাব হোসেন, রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনোয়ারুল হক, রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল প্রমুখ। 

এমএইচ

×