ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

জরাজীর্ণ ভবন, ঔষধ সঙ্কট, নিয়মিত অফিস করেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা

বেহাল দশায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত প্রান্তিক জ

নিজস্ব সংবাদাতা, শেরপুর 

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ২২ জানুয়ারি ২০২৩

বেহাল দশায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত প্রান্তিক জ

পশ্চিম কুমরী কমিউনিটি ক্লিনিকের জরাজীর্ণ ভবন।

শেরপুরে ত্রিমুখী সঙ্কটে ধুঁকছে তৃণমূল পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। অধিকাংশ ক্লিনিকের ভবনগুলোর জরাজীর্ণ ও বেহাল দশা, চাহিদার তুলনায় কম ঔষধ সরবরাহ থাকা এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) বা স্বাস্থ্যকর্মীরা অনিয়মিত যাতায়াত করায় দেখা দিয়েছে ওই সঙ্কট। 

এতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার প্রান্তিক অঞ্চলের হতদরিদ্র জনসাধারণ। অন্যদিকে অবস্থার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ রয়েছেন উদাসীন। তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বেহাল ভবনগুলো মেরামতে তালিকা প্রস্তুত করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। সেইসাথে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জোরদার করা হচ্ছে মনিটরিং। 

জানা যায়, দেশের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থল সেই ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি আবারও চালু হয়। এরপর দ্রুত কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। 

শ্রীবরদী উপজেলার খরিয়াকাজীরচর কমিউনিটি ক্লিনিকের জরাজীর্ণ ভবন এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করার কথা। তবে অযত্ন-অবহেলা, অনিয়ম আর জরাজীর্ণ ভবনের কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

শেরপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, সারা জেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ১৬৯টি। এর মধ্যে সদর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ৫৩টি, শ্রীবরদীতে ১০ ইউনিয়নে ৩৫টি, নালিতাবাড়ীতে ১২ ইউনিয়নে ৩৪টি, নকলার ৯ ইউনিয়নে ২৪টি ও ঝিনাইগাতীর ৭ ইউনিয়নে ২৩টি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই জরাজীর্ণ ও বেহাল দশা। কোন কোনটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। বর্ষাকালে ওইসব ক্লিনিকে বসে সেবা প্রদান করা সম্ভব হয় না। আবার কোনটির পলেস্তারা খসে পড়েছে। অনেকে ভয়ে ক্লিনিকে সেবা নিতেই যান না। 

অন্যদিকে জেলার ১৬৯টি ক্লিনিকের মধ্যে শুধুমাত্র ৪টি ব্যতীত বাকি সবগুলোতেই সিএইচসিপি রয়েছেন। প্রতিটি ক্লিনিক সপ্তাহে ৬দিন খোলা থাকার কথা এবং সিএইচসিপির পাশাপাশি ৩দিন করে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার পরিবার পরিকল্পনা সহায়কের সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা। তবে বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।

সম্প্রতি সরেজমিনে শ্রীবরদী উপজেলার খরিয়াকাজীরচর কমিউনিটি ক্লিনিকসহ কয়েকটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় সেগুলো তালাবদ্ধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা সপ্তাহে ৩/৪ দিনের বেশি আসেন না। সকাল ১০টা-১১টায় এলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান। 

এদিকে সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মির্জাপুর ও পশ্চিম কুমরী কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় সেবাপ্রত্যাশী নারীদের ভিড়। সেখানে সিএইচসিপির কাছে সমস্যার কথা বলে ঔষধপত্র নিচ্ছেন তারা। তবে সঙ্কটের কারণে মাসের শেষের দিকে ঔষধ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তাদের। পশ্চিম কুমরী এলাকার মালেছা বেগম ও সাবিনা বেগম বলেন, তারা সাধারণ অসুখ-বিসুখে এ ক্লিনিক থেকে ওষুধ নেন। তবে মাসের শেষে ওষুধ পাওয়া যায় না। সরকার ওষুধের বরাদ্দ বাড়ালে আমাদের জন্য ভাল হইতো। শ্রীবরদীর খরিয়াকাজীরচর এলাকার আলেছা বেগম বলেন, এই ক্লিনিকটা ভাইঙাচুইরা গেছে। 

বৃষ্টির দিন ভিতরে পানি পড়ে। তখন আমার বাড়িতে বসে ওষুধ দেয়। বিল্ডিংটা ঠিক করা দরকার। নাইলে কোনদিন জানি ভাইঙা পড়ে যাব। মো. আব্দুর রহিম জানান, সিএইচসিপি প্রতিদিন ঠিকমতো আসেন না। মাঝে মাঝে আসেন। আসলেও দুপুরের আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান। সদর উপজেলার যোগিনীমুরা এলাকার বাসিন্দা বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম জানান, এখানের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি ভবনটিরও দেখভাল করেন না। এতে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভবনটি নষ্ট হচ্ছে।

মির্জাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি নুসরাত জাহান ও পশ্চিম কুমরী কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সৈয়দা শরুফা জাহান বলেন, ক্লিনিকে ২৭ প্রকারের ওষুধ দেওয়া হয়। ২ মাসের জন্য সেগুলো দেওয়া হলেও তা ৬ হাজার মানুষের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এজন্য মাসের শুরুতেই তা শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চাদের সর্দি-জ্বর ও পাতলা পায়খানার সিরাপের চাহিদা বেশি থাকলেও তা পরিমাণে কম পাওয়া যায়। বরাদ্দ আর একটু বাড়ালে আমাদের জন্য ভালো হতো। 

ঝিনাইগাতী উপজেলার দিঘীরপাড় ও রাঙামাটিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকসহ কয়েকটি ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা কাঁচা হওয়ায় বর্ষাকালে সেবা নিতে ভোগান্তিতে পড়েন। তাই ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা দ্রুত পাকা করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নালিতাবাড়ী উপজেলাতেও অধিকাংশ ক্লিনিকের ভবন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কোথাও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। তবে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিকেই রোগীদের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। 

রূপনারায়নকুড়া ইউনিয়নে সড়কের পাশে কিল্লাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিকটি সড়ক থেকে অনেক নিচুতে। যেখানে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামুল মান্না বলেন, ক্লিনিকে তো সময়মতো লোক পাওয়া যায় না। ওষুধ আনবার গেলে শুনি ওষুধ শেষ হইয়া গেছে। পরে বাধ্য হইয়াই উপজেলা হাসপাতালে যাই। কিল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা গৃহিনী মমতাজ বেগম বলেন, দুপুর না হইতেই তো ক্লিনিক বন্ধ হইয়া যায়। 

এ ব্যাপারে শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান আরও বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এতে সেবার মান আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে, আশা করছি সেবার মান আরও বাড়বে। 

তিনি আরও বলেন, জেলার জরাজীর্ণ ভবনগুলো মেরামতযোগ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ- এ ৩ ক্যাটাগরিতে তালিকা তৈরি করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি এ বিষয়েও শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বর্তমানে ওষুধের কোন সঙ্কট নেই। তবে সরকার যদি বরাদ্দের পরিমাণ আরও বাড়ায়, তাহলে জনগণকে আরও বেশি পরিমাণে ওষুধ দেওয়া সম্ভব হবে। 

এমএস

×