ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

টেনিসের আদর্শ সানিয়া মির্জা

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

টেনিসের আদর্শ সানিয়া মির্জা

সানিয়া মির্জা

ধন্যবাদ সানিয়া একটা গোটা জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য। ভারতে অগণিত মেয়ে তোমাকে দেখে টেনিস খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছে এবং আগামী দিনেও পাবে। র‌্যাকেট হাতে কোর্টে সফল ক্যারিয়ারের পর আশা করি টেনিস ছাড়ার পর বাকি জীবনটাও ভালো কাটবে।’- লিখেছেন শচীন টেন্ডুলকর। ব্যাটিং অধিশ্বর যদি ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি হন সানিয়া মির্জাকে দেশটির টেনিসের কিংবদন্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। হিন্দুপ্রধান দেশের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি দেখিয়েছেন ইচ্ছা থাকলে সব সম্ভব।

দেড় যুগের পেশাদার ক্যারিয়ারে ৪৪ সাফল্যের ৬টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম। তিনটি মেয়েদের দ্বৈতে, বাকি তিনটি মিশ্র দ্বৈতে। গ্র্যান্ডস্ল্যামে সানিয়ার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে, এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেই, শিরোপা জিতেছিলেন ২০০৯ সালে। ১৮ বছরের ব্যবধানে সেখানেই খেললেন শেষ গ্র্যান্ডস্লাম টুর্নামেন্ট। যদিও এবার মিশ্র দ্বৈতের ফাইনালে স্বদেশী বোপান্নাকে নিয়ে ফাইনালে হেরে গেছেন ব্রাজিলের জুটির কাছে। বয়স ৩৭Ñএর কোটায়। আগেই জানিয়েছিলেন, এটিই তার শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম। 
‘আমার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল এই মেলবোর্নে। যখন ২০০৫ সালে সেরেনা উইলিয়ামসের বিপক্ষে তৃতীয় রাউন্ডে খেলতে নেমেছিলাম। বার বার এই কোর্টে খেলার সুযোগ পাওয়া, কিছু টুর্নামেন্ট জিততে পারা আমার জন্য সম্মানের। রড লেভার অ্যারেনা আমার জীবনের বিশেষ কিছু। কখনো ভাবিনি সন্তানের সামনে গ্র্যান্ডস্লাম ফাইনাল  খেলব, এ রকম বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যারিয়ারকে বিদায় জানাতে পারব। মনে হয়েছে, আমি বাড়িতে আছি। এমন অনুভূতি উপহার দেওয়ায় সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ম্যাচ শেষে অনুভূতি জানাতে গিয়ে এক পর্যায়ে আবেগে চোখ ভিজে ওঠে সানিয়ার, ‘এটা কষ্টের নয়, আনন্দের কান্না। এই মুহূর্তটা আমি ব্রাজিলের জুটির থেকে কেড়ে নিতে চাই না।

তোমরা দারুণ খেলেছ।’ শুধু শচীন নন, ক্রীড়াঙ্গনসহ অন্য অঙ্গনের অনেক তারকাই সানিয়াকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তারকা কুস্তিগীর ভিনিট ফোগাট বলেছেন, ‘তুমি আইকন।’ স্বামী পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার শোয়েব মালিক অভিব্যক্তি,‘শুধু আমার স্ত্রী হওয়ার জন্য নয়, একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে সানিয়ার সাফল্য এই উপমহাদেশের অনেক মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, লড়াই করার সাহস যুগিয়েছে। গ্র্যান্ডস্ল্যাম টুর্নামেন্টের বিদায়টাও হলো এমন জায়গায়, যেখানে ওর পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল।’

পারিবারিক জীবনে শীতল সম্পর্কের খবর যে কেবলই গুজব, এই বক্তব্যে সেটিও পরিস্কার, ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের আশা তুমি। তুমি ক্যারিয়ারে যা পেয়েছ, তার জন্য আমি গর্বিত। তুমি অনেকের প্রেরণা, আরও শক্তিশালী হও। তোমাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।’
অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে মিশ্র দ্বৈতের ফাইনালে এদিন ব্রাজিলিয়ান জুটির বিপক্ষে বোপান্নাকে নিয়ে প্রথম সেটের অষ্টম গেমে প্রতিপক্ষের সার্ভিস ভেঙে সানিয়াই এগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের গেমেই তাদের সার্ভিস ভেঙে যায়। টাইব্রেকারে গড়ানো সেটে ২-৭ গেমে হেরে যায় তারা। এরপর আর ছন্দ খুঁজে পায়নি ভারতীয় ইতিহাসের সেরা জুটি। দ্বিতীয় সেটেও লড়াই করতে পারেনি, হার ২-৬ গেমে। সেকেন্ড সার্ভিস পার্থক্য গড়ে দেয়। বিশেষ করে লুইসা স্টেফানির দ্বিতীয় সার্ভিস ছিল অসাধারণ।

এরপর প্রতিপক্ষ এগিয়ে যায় ৪-১ গেমে। সানিয়ারা আর ফিরতে পারেননি। ২০০৯ সালে মহেশ ভূপতির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ২০১২ সালে মহেশের ফরাসি ওপেনের মিশ্র দ্বৈত, ২০১৪ সালে ব্রুনো সর্সের সঙ্গে ইউএস ওপেনের মিশ্র দ্বৈত, ২০১৫ -এ উইম্বলডনের দ্বৈত, একই বছর ইউএস ওপেনের দ্বৈত এবং ২০১৬ সালে মার্টিনা হিঙ্গিসকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের খেতাব জেতেন সানিয়া। ভারতীয় ইতিহাসের একমাত্র প্রমীলা একক টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্কিংয়ের ৩০ নম্বরে ছিলেন তিনি। 
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় সংসার করছেন সানিয়া ও মালিক। তবে তাদের সংসারে অশান্তি এমনকি বিচ্ছেদের গুজব খবরে এসেছে। শেষ পর্যন্ত যদিও তা গুজবই থেকে গেছে। নতুন বছর ২০২৩ সালের প্রথম দিনে নিজের ইনস্টাগ্রামে ছেলের সঙ্গে ছবি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার কাছে বিদায়ী ২০২২ সাল স্মরণ করার জন্য বড় বা গভীর কোনো ক্যাপশন নেই। যদিও আমার কিছু সুন্দর সেলফি আছে, আপনাদের সকলকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

বিদায়ী বছরটা আমার জন্য বিশেষ ভালো ছিল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ঠিক আছে।’ সানিয়া, মালিকের চার বছর বয়সী ছেলের নাম ইজহান। সানিয়া সম্প্রতি দুবাইয়ে একটি টেনিস একাডেমি চালু করেছেন, যা ইতোমধ্যে তিনটি স্থানে কার্যক্রম শুরু করেছে। খুব শীঘ্রই আরও দুটি একাডেমি খুলবেন। ‘আমরা টেনিসকে মানুষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করে সেটি বাস্তবায়ন করব। অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাই।’ গত বছরের শেষদিকেই বলছিলেন সানিয়া।

তখনই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন এ বছর দুবাই ডিউটি ফ্রি টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের পর পেশাদার টেনিসকে বিদায় জানাবেন। ‘আমার বয়স এখন ৩৬, স্বাভাবিক ভাবেই শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। অবসরের এটিই প্রধান কারণ। আমি ২০০৩ সালে পেশাদার হয়েছিলাম। এটা সত্যি যে এই পর্যায়ে আর লড়াই চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়। বিদায়ের জন্য আমি দুবাই ডিউটি ফ্রি চ্যাম্পিয়নশিপকেই বেছে নেব।’ 
উল্লেখ্য, শোয়েব মালিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর গত প্রায় এক দশক দুবাইয়ে বসবাস করছেন সানিয়া মির্জা। সেখানে সংসার পেতেছেন, বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। দুবাইয়ে তার প্রচুর ভক্ত-অনুরাগী রয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়ত সেখানেই থাকবেন। তাই চুড়ান্ত বিদায়ের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ মরুর শহরটিকে বেছে নিতে চাইছেন। ‘গত বছর ডব্লিউটিএ ফাইনালের পরই আমি থামতে চেয়েছিলাম, কারণ সেখানে আমি ফাইনালে উঠতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু ইউএস ওপেনের ঠিক আগে পাওয়া কনুইয়ের চোটের কারণে সকল পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়েছিল। সত্যি বলতে, আমি একজন মানুষ যে নিজের কিছু শর্ত পূরণ করতে পছন্দ করি। আমি বাধ্য হয়ে মাঠের বাইরে থেকে বিদায় নিতে চাইনি। তাই ইনজুরি থেকে সের ওঠার পর নতুন করে শুরু করেছি। প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ছেলের সামনে এবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে খেলা বড় পাওয়া। তবে আমার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হলো, দুবাইয়ে ডিউটি ফ্রি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে টেনিস থেকে অবসর নেয়া।’ বলেন তিনি। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু দুবাই টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানেই দুই দশকের ক্যারিয়ারের ইতি টানাবেন ভারতীয় টেনিসের আদর্শ সানিয়া মির্জা।

×