
সুলেমান
বিগত ছয় মৌসুম ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সুলেমান দিয়াবাতে। মালির এই তারকা অনেকটা একাই টেনে নিয়েছেন বিখ্যাত সাদা-কালোদের। অথচ সেই মোহামেডান তাঁকে আর মূল্যায়ন করছে না। নতুন মৌসুমে সুলেমানকে দেখা যাবে মোহামেডানের চিরশত্রু ক্লাব ঢাকা আবাহনীতে!
সুলেমান নতুন মৌসুমে মোহামেডানে থাকছেন না এটা নিশ্চিত হয়েছে কয়েকদিন আগেই। মোহামেডান ক্লাব নিজেদের পক্ষ থেকেই দীর্ঘদিনের এই সঙ্গীকে না করে দিয়েছে। এরপর নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে ঠিকানা বদলের আভাস নিজেই দিয়েছেন দিয়াবাতে। এর পর থেকেই ফুটবল অঙ্গনে প্রশ্ন ছিল, মালির এই গোলমেশিনকে এবার কোন ক্লাবে দেখা যাবে? এ বিষয়ে সুলেমান এখন পর্যন্ত কিছুই পরিষ্কার করেননি। তবে শোনা যাচ্ছে, মোহামেডানের ছেড়ে দেওয়া এই স্ট্রাইকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী।
একটি সূত্র দাবি করেছে, নতুন মৌসুমে সুলেমানকে আবাহনীর জার্সি গায়ে দেখা যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। যদিও আবাহনী থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। আজ থেকে আবাহনী এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের প্রস্তুতি শুরু করবে। মালির এই ফরোয়ার্ড ২০১৯ সালে মোহামেডানে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে সাদা-কালোদের ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মোহামেডানের জার্সিতে খেলেছেন শতাধিক ম্যাচ। গোল শতাধিক।
জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের দীর্ঘ পথচলায় সঙ্গী হয়েছেন অসংখ্য বিদেশি ফুটবলার। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি ফুটবলার আমদানি করেছিল মোহামেডানই। ১৯৭৪ সালে ভারতের চন্দ্রশেখর প্রসাদ ও প্রভাকর মিশ্র খেলেন ঢাকা মোহামেডানের হয়ে। ১৯৭৭ সালে মোহামেডানে খেলেন পাকিস্তানের কালা গফুর, আশিক আলী, ফজলুর রহমান ও আফজাল হোসেন।
সেই থেকে মোহামেডানে অনেক বিদেশি ফুটবলারের আগমন ঘটেছে। এদের মধ্যে ১৯৯৪ সালে নাইজিরিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলা এমেকা ইউজুগো, ভিজেন তাহিরি, গোলাম মুর্তজা, নালজেগার, বোরহানজাহেদ, ওলেগ জিবৎনিকভ, আন্দ্রে কাজাকভ, লাডি বাবা লোলা, বোডে বাবা লোলা, রহিমভ উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ করতে হবে একজন নাসের হেজাজির নামও। প্রয়াত হেজাজি এশিয়া মহাদেশের কিংবদন্তি গোলরক্ষক। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৮৭ সালে মোহামেডানে আসেন কোচ কাম খেলোয়াড় হিসেবে। ঢাকার মাঠে একটি ম্যাচই খেলেছেন। আবাহনীর বিপক্ষে গোলরক্ষক ছাইদ হাসান কানন ইনজুরিতে পড়লে মাঠে নামেন হেজাজি।
কিছু সময় মাঠে ছিলেন। কিন্তু চিনিয়েছিলেন নিজের জাত। নাসের হেজাজির অধীনে মোহামেডান বাংলাদেশ তো বটেই; এশিয়ার ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতায়ও সুনাম কুড়িয়েছে। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন হেজাজি।
সাম্প্রতিক মোহামেডানের হয়ে আলো ছড়িয়ে চলেছেন উজবেক তারকা মোজাফর মোজাফরভ, নাইজিরিয়ার ইমানুয়েল সানডে, ইমানুয়েল টনি। কিন্তু দলের নিউক্লিয়াস সুলেমান দিয়াবাতে। মালির ফুটবলার দিয়াবাতে ভক্তদের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘কিং সুলেমান’ হিসেবে। সত্যিই তিনি ‘কিং’। অন্তত বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে। ২০১৯ সালে দিয়াবাতে মোহামেডানে যোগ দেন। সেই সময়ে মোহামেডান ছন্নছাড়া এক দল। পেশাদার লিগে টিকে থাকার লড়াই। দিয়াবাতে একাই টেনেছেন মোহামেডানকে।
মোহামেডান হয়ে পড়ে দিয়াবাতে নির্ভর ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। মোহামেডানের জার্সিতে সুলেমান ষষ্ঠ মৌসুম খেলেছেন। ইতোমধ্যেই পেরিয়েছেন ১০০ গোলের মাইলফলক। ঢাকা মোহামেডানের হয়ে কোনো ফুটবলারের ১০০ গোল নেই। আবাহনীর জার্সিতে শেখ মো. আসলামের আছে। আর বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম বিদেশি ফুটবলার হিসেবে দিয়াবাতে গড়েছেন গোলের সেঞ্চুরির রেকর্ড।
২০২৩ সালের ২২ মে দিনটি মোহামেডান সমর্থকরা মনে রাখবে আজীবন। কুমিল্লার ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ফেডারেশন কাপ ফাইনাল। মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান এবং আবাহনী। অবিশ্বাস্য উত্থান-পতনের ম্যাচের ১২০ মিনিট ৪-৪ গোলে সমতায়। দিয়াবাতে একাই মোহামেডানের পক্ষে করেন ৪ গোল। বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল ইতিহাসে কোনো ফাইনালে একজন খেলোয়াড়ের চার গোল করার প্রথম রেকর্ড। টাইব্রেকারেও গোল করতে ভুল করেননি দিয়াবাতে। ২০১৪ সালের স্বাধীনতা কাপের পর দিয়াবাতের অনন্য নৈপুণ্যে ফেডারেশন কাপ জয় করে মোহামেডান।
ব্রিটিশ শাসনামলে মোহামেডান প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম জাগরণের প্রতীক হিসেবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসনামল কিংবা ১৯৭১ সাল পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে মোহামেডান দুর্দান্ত সফল এক দল। যাদের ঝুলিতে রয়েছে তিনটি আগা খান গোল্ডকাপের আন্তর্জাতিক শিরোপা। ১৯৮২ সালে ভারত থেকে প্রথম বাংলাদেশি দল হিসেবে মোহামেডান জয় করে আশিস-জব্বার টুর্নামেন্ট। মোহামেডানের ট্রফি শো-কেসে আছে সবমিলিয়ে ১৯টি লিগ শিরোপা।
এছাড়া ১১টি ফেডারেশন কাপ, তিনটি স্বাধীনতা কাপ আর দুটি সুপারকাপসহ অসংখ্য শিরোপা জয়ে মোহামেডানের সাফল্য ভা-ার পূর্ণ। কিন্তু ২০০২ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আর ২০০৬ সালের জাতীয় লিগের পর মোহামেডানের শিরোপা ভাগ্যে গ্রহণ লাগে। ২০০৮ আর ২০০৯ সালের ফেডারেশন কাপ, ২০১৩ সালের সুপার কাপ আর ২০১৪ সালের স্বাধীনতা কাপে থেমে যায় মোহামেডানের ট্রফি উল্লাস। প্রায় এক দশক কেটেছে ট্রফিহীন। সেই ট্রফি খরা কেটেছে ২০২৩ সালের ফেডারেশন কাপে সুলেমান দিয়াবাতের অনন্য নৈপুণ্যে।
২০২৪-২৫ মৌসুমের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে জয়ে দিয়াবাতে ১৭ ম্যাচে করেছেন ১৪ গোল। ২০২১-২২ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ২২ গোল করে সেরা গোলদাতা ছিলেন মালির ফরোয়ার্ড। বিগত দুটি আসরেও যথাক্রমে ১৬ আর ১৭টি গোল করেছিলেন তিনি। সাদা-কালোদের বাঁচিয়ে রাখার সেই কারিগর অবশেষে ঠিকানা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন মোহামেডান কর্মকর্তাদের অনীহা আর অবহেলার কারণে।
প্যানেল হু