ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

কঠিন সময় যাচ্ছে গোলরক্ষক মহসিনের 

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:২২, ৬ জুন ২০২৩

কঠিন সময় যাচ্ছে গোলরক্ষক মহসিনের 

মোহাম্মদ মহসিন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ফুটবলে সেরা গোলরক্ষকদের একজন মোহাম্মদ মহসিন। একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও দৃঢ়তা দেখিয়ে প্রায় দেড় দশক ফুটবল মাঠে রাজত্ব করেছেন। তার গ্রিপিং, পজিশন জ্ঞান ও গেম রিডিং ছিল চমৎকার। বডি ফিটনেস, অসীম সাহস, ক্ষিপ্রতা ও নিখুঁত অনুমান ক্ষমতার কারণে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের পক্ষে তাকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ানো ছিল খুবই কঠিন। তীব্রগতির শটের সামনে বুক চিতিয়ে দুর্ভেদ্যপ্রাচীর হয়ে যেমন দাঁড়াতেন, তেমনি গোল বাঁচাতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন অবলীলায়। উচ্চতায় একটু খাটো হলেও তা পুষিয়ে দিতেন তীক্ষè বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে। কোনো কিছুতেই বিচলিত হতেন না। 
৫৮ বছর বয়সী সেই মহসিন আজ ভালো নেই। অসহায়-করুণ দশা হয়েছে তার। পরিণত হয়েছেন মানসিক রোগীতে! দাম্পত্য কলহের পর মহসিনের সংসার ভেঙে যায় (২০১৩), ২০১৪ সালে কানাডা থেকে দেশে ফেরেন। সাভারে জমি কিনলেও কিছু সন্ত্রাসী তা দখল করে নেয়। সারাজীবনের সঞ্চয় হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এসবের ধাক্কা আর নিতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীর শুকিয়ে কংকালসার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হন। এর সম্পূর্ণভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বিপদ ‘স্মৃতিভ্রংশ’ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন মহসিন। এখন রাজধানীর একটি বাসায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

ফুটবলে অসামান্য অবদান রাখায় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া মহসিন বেশি খ্যাতি পেয়েছিলেন কাজী মো. সালাউদ্দিনের পেনাল্টি রুখে দিয়ে। ঘরোয়া ফুটবলে মহসিন খেলেছেন রেলওয়ে ব্লুজ (দ্বিতীয় বিভাগে), আবাহনী ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। ১৯৮৫ সালে মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৯১ সালে তার অধিনায়কত্বে আবাহনী অপরাজিত লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনিই একমাত্র ফুটবলার যিনি মোহামেডান ও আবাহনীর অধিনায়ক হওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আবাহনীর হয়ে তিনবার (১৯৮১, ১৯৮৯-৯০, ১৯৯১) এবং মোহামেডানের হয়ে ২ বার (১৯৮২ ও ১৯৮৬) লিগ চ্যাম্পিয়ন এবং মোহামেডানের হয়ে ২ বার (১৯৮২ ও ১৯৮৩) ও আবাহনীর হয়ে ১ বার (১৯৮৮) ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলেছেন।

১৯৮২ সালে ভারতের কলকাতায় আশীষ জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন, ভারতের নাগজি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতার চার্মস কাপে চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে তিনি দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন। ১৯৯৪ সালে পুল ভেঙে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রে। তার অধিনায়কত্বে মুক্তিযোদ্ধা ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৯৫ সালে অবসান ঘটে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে দীর্ঘ এক যুগ ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মহসিন বিশ্বস্ততার সঙ্গে আগলেছেন গোলপোস্ট।

১৯৮২ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হলেও খেলার সুযোগ পাননি। তবে ওই বছরই দিল্লি এশিয়ান গেমসে তার অভিষেক হয়। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব ফুটবলের গ্রুপ ২-এর খেলা, ১৯৯১ সালে কলম্বোয় সাফ গেমসে এবং ১৯৯৩ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আলজেরিয়ার মতো শক্তিশালী দলের পেনাল্টি শট রুখে দেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। সহজাত দক্ষতার অধিকারী যে মহসিন নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হিসেবে, সেই মহসিনের আজ অর্থ-স্বাস্থ্য-মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক।

×