ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সময়ের সেরা তারকা আলফাজ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৫ অক্টোবর ২০১৬

সময়ের সেরা তারকা আলফাজ

্র ফুটবলের সঙ্গে কিভাবে জড়ালেন? ** দেশের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জে হলেও বাবার চাকুরির সুবাদে ঢাকাতেই কাটে ছোটবেলা। পলাশীতে থাকার সময় ফাঁক পেলেই মাঠে ছুটে যেতাম ফুটবল খেলতে। তা ছাড়া সে সময় অনেক মাঠ ছিল ঢাকা শহরে। জমজমাট ঢাকা লিগ ছিল । মাঠে এবং মাঠের বাইরে আলোচনা হতো ফুটবল আর তারকা ফুটবলারদের নিয়ে। এ বিষয়টা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। যাই হোক ১৯৮৫ সালে কিশোর লিগে অংশগ্রহণ করি। তারপর পাইওনিয়ার ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল খেলে একসময় সিনিয়র ডিভিশনে ছিলাম নিয়মিত। ্র যেসব তারকা ফুটবলারদের খেলা দেখে বা আলোচনা শুনে আপনার ফুটবলের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল তারা কারা? ** কায়সার হামিদ ভাই, সাব্বির ভাই, আসলাম ভাই, মোনেম মুন্না ভাই ছাড়াও আর অনেকে। উনাদের খেলা দেখতাম। আর দেখতাম মাঠের বাইরে উনাদের জনপ্রিয়তা। এই বিষয়টা আমাকে ফুটবলার হতে খুব সাহায্য করেছিল। ্র যতদূর জানি আপনি প্রথমে ছিলেন মিডফিল্ডের খেলোয়াড়, স্ট্রাইকার কিভাবে হলেন? ** হ্যাঁ আমি খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু থেকেই মিডফিল্ডের খেলোয়াড় ছিলাম, ঘটনাক্রমে আমার স্ট্রাইকার পজিশনে আসা। আমি ১৯৯৬ সালে মোহামেডানে মিডফিল্ডার হিসেবেই যোগদান করি। সে সময় মোহামেডানের কোচ ছিলেন কোরিয়ার ম্যান ইয়াং ক্যাং। মোহামেডানে তখন স্ট্রাইকার সঙ্কট। ক্যাং আমাকে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলালেন। আমি প্রথম দুই ম্যাচেই গোল করি। তারপর এই পজিশনেই নিয়মিত খেলতে থাকি। ব্যাস সেখান থেকে স্ট্রাইকার পজিশন আমার জন্য পাকাপোক্ত হয়ে যায়। ্রআপনি জাতীয় দলেও তো এই পজিশনে খেলেছেন? ** হ্যাঁ কোচ অটোফিস্টার আমাকে জাতীয় দলে স্ট্রাইকার হিসেবেই ডেকেছিলেন। ্র মোহামেডানে কিভাবে আসলেন? ** ১৯৯৪ সালে তখন রহমতগঞ্জে খেলি। সে সময় আবাহনী চার্মস কাপে আমাকে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে ভারতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এসে যোগ দেই আরামবাগে। তখন মোহামেডান-আবাহনী দুই দলই আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। দুই দলে তারকা খেলোয়াড় বেশি থাকায় আমি সেবার আরামবাগে যোগ দেই। পরবর্তীতে সার্ক গোল্ড কাপের জন্য জাতীয় দলে ডাক পাই। ১৯৯৫ সালে মোহামেডান আমন্ত্রণ জানালে আমি মোহামেডানে যোগ দেই। ্র আবাহনীতে কখন খেলেছেন? ** ২০১০ সালে। সে বছর অবশ্য মাঠে নিয়মিত ছিলাম না। কিন্তু বরদুলাই ট্রফির ফাইনালে আমার গোলেই আবাহনী শিরোপা জিতেছিল। ্রপ্লেয়ার অফ দি মান্থ হয়েছিলেন একবার মনে আছে? ** হ্যাঁ মনে আছে। ১৯৯৬ সালে মোহামেডানের হয়ে এএফসি উইনার্স কাপে অংশগ্রহণ করি। সে বছর ঢাকায় লাউসের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করি। এ ম্যাচেও একটি গোল করি। এএফসি আমাকে ৯৬ সালের আগস্টের ‘প্লেয়ার অফ দি মান্থ’ ঘোষণা করে। এটা আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। ্র জাতীয় দলের হয়ে আপনার সেরা মুহূর্ত কোনটা? ** অবশ্যই ১৯৯৯ সালের সাফ গেমসে ফুটবলে স্বর্ণ জয়। নেপালের মাঠে খুব কঠিন ছিল আমাদের সে ম্যাচটা। আমরা এক গোলেই নেপালকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো স্বর্ণ জয়লাভ করি। আজও আমার সেই স্মৃতি মনে আছে স্পষ্ট। ্র ক্লাবের হয়ে সেরা মুহূর্ত কোনটা? ** সেটা সাদাকালো জার্সি গায়ে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে। ১৯৯৯ সালের কথা। মিরপুর স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। মোহামেডান সেদিন জিতলেই এক ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন হবে এ রকম একটা পরিস্থিতিতে মোহামেডান আবাহনীকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে। যার দুটি গোল ছিল আমার দেয়া। তাছাড়া ২০০৫ সালে জাতীয় ফুটবল লিগ ফাইনালে আবাহনীকে ২-০ গোলে হারাই।এর মধ্যে একটি গোল আমি করেছি। এটা বেশি স্মরণীয় কারণ আমি সেবার মোহামেডান দলের অধিনায়ক ছিলাম। ্রএবারের বিপিএল মোহামেডান এখনও একটি ম্যাচেও জয় পায়নি। একজন মোহামেডানপ্রেমী এবং ক্লাবটির সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে বিষয়টা কিভাবে দেখছেন? ** অবশ্যই কষ্ট দিয়েছে। শুধু আমাকে নয় সাবেক সব মোহামেডান খেলোয়াড়দের বিষয়টা সাংঘাতিকভাবে পীড়া দিচ্ছে। আমরা মোহামেডানে খেলেছি চ্যাম্পিয়নের জন্য। কখনও জয় ছাড়া ড্র কল্পনাও করতাম না। ্র ঢাকা ফুটবলে কার খেলা আপনার মনে ধরেছিল? ** রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির এবং আরমান মিয়া। তাদের দুজনের পায়ের কাজ ফুটবল সেন্স ছিল অসাধারণ। এদের মতো ফুটবলার দেশের মাটিতে আর দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। ড্রিবলিং করতে করতে দু’একজনকে কাটিয়ে ডান কিংবা বামদিক থেকে গোল মুখে যে ক্রসগুলো করত তা ছিল দেখার মতো। ্রআরমানের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন? ** আরমান আমার ছোট বেলার বন্ধু। আমরা এক সঙ্গেই খেলোয়াড়ি জীবন পার করেছি বহু বছর। কিশোর লিগ থেকে একসঙ্গে খেলেছি। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ভারতের জুনিয়ার দলের সঙ্গে একটা প্রীতি ম্যাচ হয়েছিল। সে ম্যাচে আমি আর আরমান একসঙ্গে দলে ছিলাম। আমরা ম্যাচটা ১-০ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করি। তারপর জাতীয় দলে মিয়ানমার চারজাতি টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু হয় আমাদের পথচলা। ২০০৩ সালে ব্রাদার্সেও একই সঙ্গে ছিলাম। আরমানের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। তার ফ্রিকিক ছিল দেখার মতো। দুই-তিনজন খেলোয়াড়দের মাঝখান থেকে সতীর্থদের আরমান যেভাবে বল ডেলিভারি দিত তা আজকাল দেখা যায় না। সাব্বির আর আরমানের মতো ফুটবলার আজ দেশে থাকলে বাংলাদেশ দল অন্যরকম হতো। ্রফুটবলের এই বাজে অবস্থার জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন? ১৯৯০ সালে একজন খেলোয়াড় এক লিগ খেলতে পারবে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং সোহরাওয়ার্দী কাপ শেরে বাংলা কাপ এই জাতীয় টুর্নামেন্ট দীর্ঘদিন ধরে না হওয়া। সর্বপরি নিটল টাটা জাতীয় ফুটবল লিগ বন্ধ। কারণ তখন এই টুর্নামেন্টে দেশের সকল স্থান থেকে খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করত। টুর্নামেন্ট শেষে বিভিন্ন ক্লাবগুলো সেখান থেকে খেলোয়াড় নিজেদের দলে নিয়ে আসত। তাছাড়া হুট করে প্রফেশনাল লিগ চালু করা। ্রএই মুহূর্তে ফুটবলের জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত? ** অবশ্যই সহরাওয়ার্দী কাপ শেরে বাংলা কাপ এই জাতীয় টুর্নামেন্ট পুনরায় চালু করতে হবে। জেলাভিত্তিক লিগসহ নিটল টাটা জাতীয় ফুটবল লিগ চালু করতে হবে। তা ছাড়া এএফসির অনুদান থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কোচ দিয়ে বিভিন্ন জেলায় দায়সারা গোছের কোচিং বাদ দিয়ে খেলোয়াড় খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একেক কোচের তত্ত্বাবধায়নে থাকা খেলোয়াড় দিয়ে প্রতিবছর টুর্নামেন্টের আয়োজন করা। এতে করে একজন কোচের মান এবং কোন মানের খেলোয়াড় তিনি বাছাই করেছেন তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। সরকার প্রতিবছর যে বাজেট দেন তা দিয়ে শুধু স্টেডিয়াম সংস্কারের কাজ করলেই হবে না। এই অর্থকে ফুটবলের স্বার্থে ব্যয় করতে হবে। ক্লাব ফুটবল এবং জাতীয় দল দুই ক্ষেত্রেই ফুটবল খেলে আলফাজ তৃপ্ত। যতদিন খেলেছেন সুনামের সঙ্গেই খেলেছেন। মোহামেডানের হয়ে ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে, ব্রাদার্সের হয়ে ২০০৩ সালে লিগ চ্যাম্পিয়নের স্বাদ গ্রহণ করেন। তা ছাড়া টানা চারবার জাতীয় লিগ শিরোপা জয় করে আলফাজ। পেশাদার লিগের প্রতিটি আসরে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে সাফের রানার্স আপ এবং ১৯৯৯ সালে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। আলফাজের ফুটবল ক্যারিয়ার গর্ব করার মতোই। দীর্ঘদিন ফুটবলের সঙ্গে থেকে অবশেষে আলফাজ ২০১২ সালে মোহামেডান বনাম আবাহনীর খেলার দিন ফুটবল থেকে অবসর নেন। আলফাজ আহমেদ এবার চিটাগং মোহামেডানের কোচিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার ইচ্ছা এই কোচিং পেশার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখা। আলফাজ ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা মোহামেডানে টানা সাত বছর খেলেছেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধা আর ব্রাদার্স। ২০০৩-২০০৪ মৌসুমে ব্রাদার্সকে চ্যাম্পিয়ন করার পেছনে আলফাজের ভূমিকা স্মরণ করার মতো। তাছাড়া ওই বছরেই সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন আলফাজ। আলফাজ আহমেদ যিনি গোল করে সাফ সর্ন জয়ের আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছিলেন বাংলাদেশের কোটি সমর্থকদের, যার ঝুলিতে আছে একশ’র বেশি জাতীয় দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা, বর্তমানে তিনি কোচিং পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন পুরোদমে। নিশ্চয় তিনি তার অভিজ্ঞতা আর নিপুণ মেধা দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন একটা লক্ষ্যে। সমর্থকরা নতুন করে একটা আশার আলো দেখতেই পারেন। আলফাজ বিয়ে করেন ১৯৯৫ সালে। স্ত্রী নাজিয়া আহমেদ বড় ছেলে রেজয়ান আহমেদ, মেয়ে রনক আহমেদ এবং ছোট ছেলে রাফিয়ান আহমেদকে নিয়ে সুখের সংসার।
×