বাংলাদেশকে সমীহ করছে টিম ইন্ডিয়া। তাই অনুশীলনে বেশ সিরিয়াস রোহিত-অশ্বিনরা
অনেকেই বলেন, অ্যাশেজের তুলনা শুধু অ্যাশেজই। এটা ঠিক ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজের এ দ্বৈরথ ক্রিকেটের মতোই দীর্ঘ। তবে প্রশ্ন যখন জনপ্রিয়তার, তখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অনুষঙ্গটাও বদলে যায়। এই যেমন টেস্ট ও ওয়ানডে ছাপিয়ে সময়টা এখন ধুন্ধুমার টি২০’র। উপমহাদেশের ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের সেই আগুনে উত্তাপও অনেকটাই স্তিমিত।
আয়োজনে, অর্জনে, সক্ষমতায় ভারত যেমন সবাইকে টেক্কা দিচ্ছে, সেখানে সকল বিচারেই পিছিয়ে পড়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। মাঠ ও মাঠের বাইরে প্রতিবেশী দুই পরাশক্তির মধ্যে যেখানে ক্রমাগত ব্যবধান বেড়ে চলেছে, সেখানে ক্রিকেটীয় বিচারে নতুন উত্তাপ নিয়ে হাজির বাংলাদেশ। যে উত্তাপের শুরু ২০০৭ বিশ্বকাপে, টাইগারদের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়ের দলকে।
২০১২ থেকে ২০২৩Ñ শেষ ছয় এশিয়া কাপে তিনবারই ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। যেখানে দুইবার প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মোড়লদের পক্ষে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং কিংবা ঘরের মাঠে লজ্জার হারে বিধ্বস্ত-বিভ্রান্ত মহেন্দ্র সিং ধোনির মুস্তাফিজুর রহমানকে সেই কনুইয়ের ধাক্কা!
বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান ছাপিয়ে উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে এখন ভারত-বাংলাদেশ দ্বৈরথই বরং বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ২০০০ সালে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ প্রথম টেস্টটি খেলে ভারতের সঙ্গে, ঢাকার বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। ২০২২ পর্যন্ত মোট ১৩ টেস্টে মুখোমুখি হয়ে একটিতেও জয় নেই, হার ১১, ড্র ২। সেই বাংলাদেশকেই এবার বেশ সমীহ করছেন রবিচন্দ্রন আশ্বিন, ঋষভ পন্থ, শুভমান গিলের মতো সময়ের অন্যতমসেরা সব পারফর্মার।
কারণ সদ্যই পাকিস্তানের মাটিতে প্রতিপক্ষকে ২-০’ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে এসেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। বাংলাদেশ প্রথমবার ভারতে টেস্ট খেলতে গিয়েছিল ২০১৭ সালে, টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৭ বছর পরে। ভারতে প্রথম টেস্ট খেলতে প্রায় দেড় যুগ লাগলেও সর্বশেষ আট বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ভারতে বাংলাদেশ। প্রথম সফরে ছিল একটিই টেস্ট, হায়দরাবাদে সেই টেস্টে ২০৮ রানের বড় ব্যবধানেই হেরেছিল মুশফিকুর রহিমের দল।
২০১৯ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফরে ২টি টেস্ট ও ৩টি টি২০। একটি টি২০ জিতলেও ইন্দোর ও কলকাতায় দুটি টেস্টেই বাংলাদেশ হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। কলকাতার টেস্টটি শুরুর আগে রীতিমতো আলোড়ন উঠেছিল। কারণ, এটি ছিল ভারতের মাটিতে প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট, যেটির অন্য পরিচিতি ‘পিংক টেস্ট’।
এবার শান্তর নেতৃত্বাধীন দল এমন এক সময়ে ভারতে দুই টেস্ট খেলছে, যখন পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে দুই টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে আসার আত্মবিশ্বাস তাদের সঙ্গী। ভারতও যে বাংলাদেশকে এবার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, সেটির ইঙ্গিত আছে নির্বাচকদের ঘোষিত দলে। আগামিকাল শুরু চেন্নাই টেস্টের দলে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, যশপ্রীত বুমরা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন থেকে শুরু করে ভারতের টেস্ট দলের সব তারকাই আছেন।
ভারতের শক্তিশালী স্কোয়াড গঠনের পেছনে অবশ্য এটিই একমাত্র কারণ নয়। রোহিত-কোহলিরা টেস্ট ক্রিকেটে ফিরছেন ছয় মাস বিরতির পর, তার ওপর সামনেই আছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদেরই মাঠে গিয়ে টেস্ট সিরিজ। ব্যস্ত মৌসুমের প্রস্তুতির অংশ হোক বা বাংলাদেশকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলার ভাবনা হোক, চেন্নাই টেস্টের জন্য ভারতের শক্তিশালী দল ঘোষণা বাংলাদেশের বিপক্ষে চমৎকার এক সিরিজেরই আভাস।
পাকিস্তানে অভাবনীয় সাফল্যের পর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ দলের ভারত সিরিজ নিয়ে উৎসাহী ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রশ্ন, নাজমুলরা যে ‘রেসিপি’তে পাকিস্তানকে হারিয়েছেন, সেই একই পথে রোহিত শর্মাদেরও হারানো যাবে তো? বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ানদের বিপক্ষে যা সম্ভব হয়েছে, সেটি বিরাট কোহলি-রোহিতদের বিপক্ষেও সম্ভব কি না, এই প্রশ্নে প্রথমেই দেখা দরকার বাংলাদেশ দল পাকিস্তানে কিভাবে জিতেছে।
সিরিজের দুটি ম্যাচই হয়েছিল রাওয়ালপিন্ডিতে। প্রথম ম্যাচে নাজমুলরা জিতেছিলেন ১০ উইকেটে, পরেরটিতে ৬ উইকেটে। জয়ের ব্যবধান বলে দিচ্ছে দুই টেস্টের ফলে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের বোলিং। প্রথম টেস্টে ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান। তবে অলআউট হয়েছে পরের তিন ইনিংসে। সব মিলিয়ে দুই টেস্টের চার ইনিংসে পাকিস্তানের ৩৬ ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন বাংলাদেশের বোলাররা। দেখা যাক, এই উইকেটগুলো কারা নিয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি ১০ উইকেট নিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। দলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ উইকেট হাসান মাহমুদের। এ ছাড়া নাহিদ রানা ৬, সাকিব আল হাসান ৫ ও তাসকিন আহমেদ ৪ এবং শরীফুল ইসলাম ৩টি উইকেট নিয়েছেন।
বোলিংয়ের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, দুই স্পিনার মিরাজ ও সাকিব মিলে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। আর চার পেসার হাসান, নাহিদ, তাসকিন ও শরিফুলদের শিকার ২১ উইকেট। এখানে বিশেষ ব্যাপার ছিল, রাওয়ালপিন্ডির উইকেট। পাকিস্তানের বেশিরভাগ উইকেটই পেসবান্ধব, রাওয়ালপিন্ডি একটু বেশি। সিরিজের প্রথম টেস্টে পাকিস্তান তো একাদশে কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনারও রাখেনি।
মূলত পিচের কারণেই পুরো সিরিজে বাংলাদেশ দল স্পিনারদের তুলনায় পেসারদের দিয়ে বেশি বল করিয়েছে (স্পিনাররা করেছেন ৭৯০ বল, পেসাররা ১০১৮)। তবে ভারতের মাটিতে হতে যাওয়া সিরিজে স্পিনারদেরই হাত বেশি ঘোরাতে হতে পারে। এই সিরিজে খেলা হবে চেন্নাই ও কানপুরে, যেখানকার উইকেট স্পিনবান্ধব হিসেবে পরিচিত। তবে আপডেট তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ সিরিজের পর ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলবে ভারত।
তবে এই দুই সিরিজের চেয়েও ভারতের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সিরিজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে ৫ টেস্টের সিরিজ খেলতে যাবে ভারত। যে সিরিজ চলবে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এই সিরিজের আগে ব্যাটসম্যানদের স্পিন খেলার খোলসে আটকাতে না চাওয়ারই কথা ভারতের। সঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতা তো আছেই।
২০১৯ সালে ইন্দোর ও কলকাতায় পেস বোলারদের দিয়ে বাংলাদেশকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়েছিল ভারত। বাংলাদেশ সেই সিরিজের দুই টেস্টেই হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। সেবার ভারতের পেসাররা দুই টেস্টে উইকেট নিয়েছিলেন ৩৫টি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, চেন্নাইয়ে কালো নয়, লাল মাটির উইকেটে খেলতে পারে ভারত।
স্বাগতিকরা কি তবে বাংলাদেশকে জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজদের পেস তোপের মুখে ফেলতে চাইছে? টাইগার পেসাররাও যে কম যান না, সদ্য পাকিস্তান সফরেই তাসকিন, নাহিদরা সেটি বুঝিয়ে দিয়েছেন!
ভারত যে এবার সহজে পার পাবে না পাকিস্তান সফরে সিরিজসেরা অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজের বক্তব্যেই সেটি স্পষ্ট, ‘টেস্ট ক্রিকেটে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ থাকে। প্রত্যেক সেশন, প্রত্যেক বল, সবটাই চ্যালেঞ্জ। ব্যাটসম্যান, বোলার-সবার জন্য। ভারত অবশ্যই ভালো দল।
ওদের বোলাররা অনেক ভালো। ব্যাটসম্যানরাও অনেক ভালো। ওদের যে উইকেটটা থাকে...সেখানে আমরা আগে খেলেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে উইকেটের আচরণ সম্পর্কে। আমার মনে হয় সেখানে উইকেট অনেক ভালো থাকবে। আমরা যেভাবে খেলছি, সেভাবে যদি খেলতে থাকি, ফলাফল চিন্তা না করে যদি পারফর্ম করার চিন্তা করি, তাহলে ভালো ফল আসবে।’
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ দলের ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়ছে। মিরাজরাও সে উত্তাপ টের পাচ্ছেন, ‘আমরা যখন ভালো খেলি, তখন সবারই প্রত্যাশা বাড়ে। আমাদের ভালো খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি তা করতে পারি, আমরা নিজেদেরও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।’ ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান সিরিজকেই প্রেরণা হিসেবে দেখছেন এ অলরাউন্ডার, ‘আমরা যেহেতু পাকিস্তান সিরিজটা ভালো করেছি, প্রতিবেশী দেশে এই সিরিজের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পারফর্ম করছি, সবাই যদি ভারতেও ভালো ফর্মে থাকে, তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু আশা করা যায়।’