ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

তবু আক্ষেপ স্পিনার তাইজুলের

মো. মামুন রশীদ

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

তবু আক্ষেপ স্পিনার তাইজুলের

তাইজুল

সুযোগটা কালেভদ্রেই আসে- কারণ টেস্ট ম্যাচ বাংলাদেশ কম খেলে। এখন পর্যন্ত চলতি বছরে মাত্র ৩ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগটাও কম। তবে টেস্ট ম্যাচ এলেই তাইজুল ইসলামের ওপর ভরসা করতে হয় বাংলাদেশ দলকে। 
আর যখনই সুযোগটা পান, ঝলসে ওঠেন বল হাতে। যদিও বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে সাকিব আল হাসান যখন থাকেন, অনেক সময়ই সাফল্য ভাগাভাগি করতে হয়। কিন্তু এরপরেও জেনুইন বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট পুরোপুরি নির্ভর করে তাইজুলের ওপর। যেহেতু শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই খেলেন, তাই কয়েক বছর আগেও তাইজুলের এই অবস্থানটা ছিল না। কারণ টেস্টেও সব গুরুত্ব, লাইমলাইট থেকেছে সাকিবের ওপরে। কিন্তু যখন থেকে টেস্টে সাকিব অনিয়মিত হতে শুরু করেছেন তাইজুল একাই তার ঘাটতি ভুলে থাকার মতো পারফর্ম করেছেন। এবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে অবিস্মরণীয় প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক হয়েছেন ৩১ বছর বয়সী এই বাঁহাতি স্পিনার।

সাকিব যে দলে নেই, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি দল। ঐতিহাসিক এই জয়ের নায়ক হিসেবে ম্যাচসেরাও হয়েছেন তাইজুল। কিন্তু আক্ষেপ, আফসোস তার থেকেই যায়- হয়তো দীর্ঘশ্বাসও। কারণ টেস্টে অপরিহার্য হলেও ওয়ানডে কিংবা টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলে তার সুযোগ নেই। অথচ ১৮ ওয়ানডেতে ২৩.৬০ গড়ে ৩০ উইকেট নিয়েছেন ওভারপ্রতি মাত্র ৪.৩৭ হারে রান খরচা করে। তাইতো কিউইদের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর সে বিষয়ে নিজের আক্ষেপের কথাটাও ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন। 
এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৩ টেস্ট খেলেছেন তাইজুল। ১০ ইনিংস বোলিং করার সুযোগ পাননি, কারণ দল আগেই হেরে গেছে। মাত্র ৭৬ ইনিংস বোলিং করে নিয়েছেন ১৮৭ উইকেট। ক্যারিয়ারে ১২ বার ৪ উইকেট, ১২ বার ৫ উইকেট নিয়েছেন। সাকিব ১৯ বার ৫টি ও ১০ বার ৪টি এবং মেহেদি হাসান মিরাজ ৯ বার ৫টি ও ৬ বার ৪ উইকেট নিতে পেরেছেন। সবমিলিয়ে তাইজুলের ম্যাচে অবশ্য মাত্র ২ বার ১০ উইকেট। এবার সিলেটে হওয়া সফরকারী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪টি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬টি উইকেট নিয়ে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে।

আর তাই অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েও নাজমুল হোসেন শান্ত ম্লান হয়ে গেছেন তাইজুলের এই ঝলসিত নৈপুণ্যে। ক্যারিয়ারে মাত্র দ্বিতীয়বার ম্যাচসেরা হয়েছেন দ্বিতীয়বার ম্যাচে ১০ উইকেট শিকারের কীর্তি দেখিয়ে। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে ২ বার ম্যচে ১০ উইকেটই সেরা পারফর্মেন্স। যৌথভাবে সেখানে আছেন সাকিব, মিরাজ ও তাইজুল। সাকিব ২ বার ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন এখন পর্যন্ত ৬৬ টেস্টে ও মিরাজ ৪০ টেস্টে। এখানেই তাইজুলের কৃতিত্ব থেমে থাকে না। কারণ তিনি ম্যাচে ৩ বার ৮ ও ৩ বার ৯ উইকেট পেয়েছেন। অর্থাৎ অন্তত আরও কিছু ম্যাচে তার উইকেট ১০ হতে পারত। সেটি হয়নি কারণ সাকিব ওই ম্যাচগুলোয় তার সঙ্গে উইকেট ভাগাভাগি করেছেন।

তাছাড়া মিরাজ, কিংবা নাঈম হাসানও ছিলেন। এবার অবশ্য সাকিব ছিলেন না, কিন্তু মিরাজ-নাঈম ছিলেন। তবে তাইজুলের মতো ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারেননি তারা। তাইজুল পুরোটা সময়ই প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের বেশ সমস্যায় ফেলেছেন। কিন্তু দুই সতীর্থ নাঈম-মিরাজ যেমন পারেননি, তেমনি প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড দলের দুই বিশ^মানের স্পিনার এজাজ প্যাটেল ও ইশ সোধিও আহামরি কিছু করতে পারেননি। এখানেই তাইজুলের কীর্তিটা আরও বড় হয়েছে। এজাজ কিছুটা ভালো করলেও উভয় ইনিংসে তিনি একই কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। কিন্তু দুই ইনিংসেই কিউই ব্যাটারদের জন্য ভীতিকর ছিলেন তাইজুল। 
২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শুরুতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতে পেরেছিলেন তাইজুল। সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১ উইকেট নেওয়া এ বাঁহাতি দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৯ রানেই ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত টেস্টে সেটাই বাংলাদেশের পক্ষে ইনিংসসেরা বোলিং পারফর্র্মেন্স। একই দলের বিপক্ষে সিলেটে ২০১৮ সালে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন যেটা তাইজুলের ব্যক্তিগত সেরা বোলিং পারফর্মেন্স। কিন্তু ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতে পারেননি দল ১৫১ রানে হেরে যাওয়াতে। এবার সেই সিলেটে ৫ বছর পর দলও খেলেছে এবং জয় পেয়েছে। আর জয়ের পেছনে অন্যতম অবদান রেখে ৭০.১ ওভার বোলিং করে ১৮৪ রানে ১০ উইকেট নেওয়া তাইজুল হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

৯ বছর পর আবার ম্যাচসেরা হয়েছেন তাইজুল, কারণ সেই একটাই সাকিবের ছায়া হয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। কারণ সাকিব ব্যাটে-বলে অলরাউন্ড পারফর্মেন্সে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন বারবার। এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর ম্যাচজয়ী পারফর্মেন্সে ম্যাচসেরা হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তাইজুল বলেছেন, ‘দেশের হয়ে কিছু করতে পারাটা সন্তুষ্টির। ১০ উইকেট নিতে পেরে আমার মনোবল বেড়েছে। জয় পাওয়া নিশ্চিতভাবেই দলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে সঠিক অবস্থানে নিয়ে যাবে।’ দলের জন্য যেন নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছেন তাইজুল। এতো কম ইনিংসে ১৮৭ উইকেট নিয়েছেন, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম ২০০ টেস্ট উইকেটের রেকর্ড অচিরেই গড়তে চলেছেন। কারণ ৫৪ টেস্টে সাকিব ২০০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়েছেন। 
দ্বিতীয় বোলার হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে সেই মাইলফলক আরও অনেক কম ম্যাচেই অর্জন করার পথে তাইজুল। ভারতের বাঁহাতি স্পিনার বিষেণ সিং বেদি, পাকিস্তানের পেসার ওয়াসিম আকরাম ও অস্ট্রেলিয়ার পেসার ব্রেট লি, জেফ থমসন ৫১ টেস্টে, পাকিস্তানের লিজেন্ডারি লেগস্পিনার আব্দুল কাদির, অস্ট্রেলিয়ার পেসার জেসন গিলেস্পি ৫৩ টেস্ট, ভারতের জাভাগাল শ্রীণাথ, বাংলাদেশের সাকিব ৫৪ টেস্ট, অস্ট্রেলিয়ার অফস্পিনার নাথান লায়ন, ইংল্যান্ডের পেসার জেমস অ্যান্ডারসন, দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার মাখায়া এনটিনি, ভারতের মোহাম্মদ শামি ৫৫ টেস্ট এবং নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি ৫৬, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার কোর্টনি ওয়ালশ ৫৮ টেস্টে ২০০ উইকেট পেয়েছেন। তাদের রেকর্ড পেছনে ফেলতে চলেছেন তাইজুল নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু তবু আক্ষেপ দেশের জার্সিতে ওয়ানডে ও টি২০ খেলতে না পারার। 

অথচ ওয়ানডেতে বিভিন্ন সময়ে সুযোগ পেয়েই জ্বলে উঠেছেন। ১৮ ম্যাচে ৩০ উইকেটও আছে তার। এ বছরও নাসুম আহমেদ ও তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত এশিয়া কাপ কিংবা বিশ^কাপে সুযোগটা হয়নি। অথচ আড়াই বছর পর গত জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে খেলার সুযোগ পেয়েই ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। সেই তাইজুল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আসন্ন ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজের দলেও সুযোগ পাননি। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আফসোস তো সবারই থাকে। আমারও আফসোস আছে। গতকাল তো দল দিয়েছে, হয়তো দেখেছেন। আমি আসলে এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না।’ ২০১৪ থেকে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু। সাদা পোশাকে রঙ্গিন তাইজুল ধারাবাহিকভাবেই খেলছেন। কিন্তু রঙ্গিন পোশাকে ৯ বছরে ১৮ ওয়ানডে ও ২ টি২০ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। এতোকিছু করেও কি কম গুরুত্ব পাচ্ছেন তিনি? তাইজুল বলেছেন, ‘একজন খেলোয়াড় যখন ৮-১০-১২ বছর খেলে অবশ্যই অভিজ্ঞতা থাকে। 
ক্রিকেটে এই অভিজ্ঞতা অনেক কাজে লাগে। অধিনায়ক কোচের উপর নির্ভর করে আমাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। গুরুত্ব দিলে অবশ্যই চেষ্টা করব সাহায্য করার। সবসময় আমার দরজা খোলা। যেকোনো দরকার হলে আমি করব। গুরুত্ব পাই না তা না, পাই। অনেকে অনেক সময় বলে কি করা যায়। আমি পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি।’ আফসোসটা কি ঘুঁচবে তাইজুলের? সবেমাত্র বয়স ৩১। একজন স্পিনার অনায়াসে খেলতে পারেন ৩৭-৩৮ এমনকি ৪০ বছর পর্যন্ত। ফিটনেস যদি ঠিক রাখতে পারেন, তাইজুলের তো সবেমাত্র ক্যারিয়ারের পরিণত সময় শুরু হয়েছে। আরও অন্তত ৭ বছর তিনি খেলতে পারবেন। তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এবং সব ফরম্যাটে খেলার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি তার।

×