ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শেখ হাসিনার লেখক সত্তা

র ফি কু র  র শী দ

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শেখ হাসিনার লেখক সত্তা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় এবং তাঁর অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নের সুকঠিন অঙ্গীকার নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পরিচালনার যিনি নিরলসভাবে পালন করে চলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন বিরলপ্রজ লেখক বলে এবং তাঁর মাটিলগ্ন লেখকসত্তার সুস্পষ্ট পরিচয় বছরে বছরে উন্মোচিত ও প্রতিভাত হতে দেখে সামান্য একজন লেখক হিসেবে আমিও প্রবল গৌরব অনুভব করি। টুপিখোলা কুর্ণিশ জানাই তাঁর লেখকপ্রতিভা এবং প্রজ্ঞার প্রতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে লেখক শেখ হাসিনা প্রায় সিকি
শতক গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনন্য এবং অতুলনীয়। অনতিক্রম্য বললেও বেশি বলা হবে না আশা করি। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে লেখালেখির তেমন প্রবণতা নেই বললেই চলে, পাঠাভ্যাসের ব্যাপারটাও দিনে দিনে তলানিতে ঠেকতে চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে একান্ন। এতগুলো বছরে যে সব রাজনীতিক রাষ্ট্র কিংবা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র শেখ হাসিনাই বিরল স্থাপন করেছেন- সুচারুভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে লেখালেখিও অব্যাহত রেখেছেন। একটি-দুটি বই নয়, এ নাগাদ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় সিকি শতকের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

শেখ মুজিবের কন্যা তিনি, তাঁর রক্তে মিশে আছে লেখকসত্তার দৃশ্যাতীত প্রবাহ। বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াই এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের  অপরাধে বছরের পর বছর জেল খেটেছেন বঙ্গবন্ধু, জেলখানাতে বসেই লেখালেখি চালিয়ে গেছেন, বিলম্বে হলেও তারই পরিণামে আমরা পেয়েছি অসামান্য তিনটি আকরগ্রন্থ- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন। এই বইগুলো লেখার সময় যে খাতা ব্যবহৃত হয়েছে, তা জেলখানায় সরবরাহ করেছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা। আর জেলখানায় এই লেখার খাতা পৌঁছে দেবার সময় মায়ের সঙ্গে একাধিকবার শেখ হাসিনাও গেছেন বাবার কাছে। বাবার এবং মায়ের পাঠাভ্যাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বড়ো হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেখাপড়া করেছেন, ফলে সাহিত্যমনস্ক গভীর অন্তর্দৃষ্টিও গড়ে ওঠে সেই ছাত্রবেলাতেই। কাজেই যে-কারো মনে হতেও পারে, শেখ হাসিনার জন্য লেখক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এ যেন বড়ই প্রত্যাশিত ঘটনা।
তবে কি মনেপ্রাণে লেখক হতেই চেয়েছিলেন তিনি? এমন ব্রত কিংবা আকাক্সক্ষার কথা তো কোথাও কখনো উচ্চারণ করেছেন বলেও তো জানা যায় না। তবু কিভাবে এলেন এই লেখালেখির পথে? ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘লেখক শেখ হাসিনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনার মনে সব সময় লেখকসত্তা প্রকাশের আর্তি জাগিয়ে রেখেছিল তাঁর দেশ। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু তারও আগে সাহিত্য সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে তাঁকে আমরা জানি তাঁর স্মৃতিকথায়।

সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ ও অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা- এ দুইয়ের মিলিত প্রকাশ শেখ হাসিনার লেখকসত্তা, সেই সঙ্গে তাঁর সৃজন ও মননচর্চার অভিজ্ঞান।’ সেদিনের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘কোমল-স্নিগ্ধ -পেলব ভাষাভঙ্গিতে তিনি বয়ন করে চলেন তাঁর রচনার এক একটি অক্ষর; পরম মমতায়, সংগ্রামে ও সংকল্পে যেমন রচনা করে চলেছেন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সামষ্টিক অগ্রগতির সোনালি স্বপ্ন-অক্ষর।’
শেখ হাসিনার লেখালেখিকে মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমেই আসে আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা, যেখানে উঠে এসেছে তাঁর গ্রামজীবনের কথা, শৈশব কৈশোরের স্মৃতি, পারিবারিক জীবন এবং পিতার অম্লান স্মৃতিচারণ। আর অপর অংশে তাঁর রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক চিন্তা ও উন্নয়ন দর্শন প্রতিফলিত। তাঁর মানবিক অঙ্গীকার, উপলব্ধির সততা আর প্রকাশভঙ্গির সারল্য একজন সফল রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়কের পাশাপাশি তাঁকে পরিণত করেছে একজন সফল ও দায়বদ্ধ লেখকে। এ কথা মোটেই অত্যুক্তি নয় যে, এই দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব ও প্রবল দায়িত্ববোধই তাঁর লেখকসত্তা প্রকাশের আর্তি জাগিয়ে রাখে সারাক্ষণ।
লেখক শেখ হাসিনার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত  ‘ওরা টোকাই কেন’ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। এ বইয়ের জন্য অত্যন্ত পরিমিতবাক এব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লিখেছিলেন বাঙালি মণীষার উজ্জ্বল প্রতিভূ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাধীন দেশে নাম-ঠিকানাহারা পথশিশুদের উপেক্ষিত জীবনযাপনের দৃশ্য শেখ হাসিনার সংবেদনকাতর লেখকসত্তায় প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করে, তখনই প্রশ্ন জাগে- ‘ওরা টোকাই কেন?’ একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সিকি শতাব্দীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে স্বাধীন হওয়া হতদরিদ্র এ দেশে পরাধীন আমলের মতোই নামহারা পথশিশু বা টোকাইদের দেখে একজন বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে ‘ওরা টোকাই কেন?’

বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন দেশে যে দুঃখী  মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন, পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক  চোরাবালিতে পড়ে সেই মুক্তি আসেনি এটা সহজেই উপলব্ধি করেন শেখ হাসিনা। আর তাই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনার ব্রত নিয়ে জনগণের কাতারে মিশে গিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে সচেষ্ট হন এবং এই দেশাত্মবোধই তাঁর লেখকসত্তার উন্মোচন ঘটায়। আমরা পাই লেখক শেখ হাসিনার নব পরিচয়। প্রকাশিত হয় প্রথম বই। এ বই প্রকাশের ত্রিশ বছর পর এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ত্রিশ বছর আগে শেখ হাসিনার প্রথম গ্রন্থ ‘ওরা টোকাই কেন?’র ভূমিকা লিখেছিলাম আমি। তখন ভাবিনি রাজনীতির প্রবল দাবি মিটিয়ে তিনি লেখালেখি অব্যাহত রাখতে পারবেন। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখিতেও শেখ হাসিনা সমান সক্রিয়তার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তাঁর রচনায় দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা বিস্তার এবং গণতন্ত্রের প্রসার ও জনমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্তি এই তিনটি বিষয় মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে ধরা দেয়।’
দুই খ-ে শেখ হাসিনার রচনা সমগ্র প্রকাশিত হলে বিশিষ্ট আলোকবিজ্ঞানী ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘শেখ হাসিনা ও তাঁর সাহিত্যকর্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলার রাজনীতিকদের লেখালেখিতে অনাগ্রহের প্রক্ষাপট তুলে ধরেন এবং এ ক্ষেত্রে অনন্য ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার লেখালেখির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেন। সেই নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা তাঁর মহান পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশের চার রাষ্ট্রনীতিভিত্তিক মৌলিক সত্তা রক্ষায় যেমন অঙ্গীকার দীপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি লেখালেখির মাধ্যমেও তাঁর চিন্তাচেতনা ও রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছেন।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বইপুস্তক পড়া এবং লেখালেখির অভ্যাস নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সে ক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। পিতার সেই দুর্লভ গুণ শেখ হাসিনাও যে নিপুণ দক্ষতায় অর্জন করেছেন, বর্তমান রচনাসমগ্র তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। শেখ হাসিনা বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ায় তাঁর গদ্যের বিন্যাসে কিছু পরিশীলনেরও ছাপ আছে। সব চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে এই প্রথম একজন বিপুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার রচনাসমগ্র প্রকাশিত হলো। এ ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ হবার গৌরব অর্জন করলেন।’
বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আতিউর রহমান ‘লেখক শেখ হাসিনা’ সম্পর্কে তাঁর লেখা নিবন্ধে শেখ হাসিনার বিভিন্ন রচনার গভীরে দৃষ্টিপাত করেছেন এবং সে-সব রচনার সাহিত্যবোধ নিয়ে আলোচনাও করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে শেখ হাসিনার একটি অনন্য সুন্দর সৃষ্টি। এ বইটিতে শেখ হাসিনার সাহিত্যপ্রতিভার সবটুকু নির্যাস অনুভব করা যায়। বইটি তিনি লিখতে শুরু করেছেন ২০০৮ সালে বিশেষ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বর্ষার পানিতে ঝাঁপিয়ে, শীতের রোদ গায়ে মেখে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে বেড়ে ওঠে এক কিশোরী। স্মৃতির ডানা মেলে তিনি লিখেন, ‘খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে নদীর ধারে বেড়ানো, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ পানিতে জোড়া নারকেল ভাসিয়ে অথবা কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাটা, গামছা বিছিয়ে টেংরা পুঁটি খল্লা মাছ ধরা। বর্ষাকালে খালে অনেক কচুরিপানা ভেসে আসতো।

সেই কচুরিপানা টেনে তুললে তার শেকড় থেকে বেরিয়ে আসতো কৈ আর বাইন মাছ। একবার একটা সাপ দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম।’ এইটুকু উদ্ধৃত করে ড. আতিউর রহমান মন্তব্য করেন, এমন বর্ণনা পড়ে যে কেউ ভাবতে পারেন- এ বুঝি কোনো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরই লেখা। ১৯৮৮ সালে সাপ্তাহিক রবিবারে যখন ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ নামে এ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন এমনই মনে হয়েছিল। লেখক হিসেবে নবাগত হলেও শেখ হাসিনা ততদিনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আসন রচনা করে নিয়েছেন। শুধু স্মৃতিচারণমূলক লেখাই নয়, অচিরেই তিনি প্রজ্ঞাপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক লেখাও লেখেন। তাঁর পরিপূর্ণ লেখকসত্তা উন্মোচিত হয় সর্বসমক্ষে। ড. আতিউর রহমান জানান, ‘সাহিত্যমানসের জন্য প্রয়োজন কল্পনাশক্তির। সে কল্পনাশক্তি শেখ হাসিনার কী রকম তা ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ এর প্রতিটি লেখাতেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।
‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’র   লেখক অনেক পরিণত। বাক্যের গঠন অনেক বদলে গেছে। বেশ শক্ত ও ঋজু। এর মধ্যে লেখকের অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। জীবন ও সমাজ দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে। এখন তিনি আরও বেশি পরিপক্ব।’
বড় হয়ে ওঠার পর যার বক্তব্য থেকে জানা যায় বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ তাঁর পঠিত প্রিয় বই, সেই মানুষটির সাহিত্যমানস উপলব্ধি করা যায় সহজেই; তিনি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর রচনায় একদিকে যেমন পথের পাঁচালীর মতোই বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের চালচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, অন্যদিকে প্রখর রাজনৈতিক চেতনাশাসিত প্রবন্ধগুলোতে পাওয়া যায় এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের পরিচয় এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাগুলোর সুস্পষ্ট পরিচয়।

মনে রাখতে হবে নিছক শখের বশে সাহিত্য রচনা করতে আসেননি শেখ হাসিনা, নিবিড় সাহিত্যপাঠ তাঁকে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা-হতাশার অনুভূতিগুলো অনুধাবনে বিরাট সহযোগিতা করেছে; তাই তিনি দেশ ও দেশের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবার ভাবনা থেকেই তাঁর গভীর বেদনাবোধ থেকে লেখালেখি শুরু করেন। সেই ১৯৮৯ সালে ‘ওরা টোকাই কেন’ গ্রন্থের ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘গভীর এক বেদনাবোধ থেকে শেখ হাসিনা অবলোকন করেছেন পারিপার্শ্বকে। সেই বেদনাবোধ ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনার অধিকাংশ স্থানে।’
কী সেই বেদনা? বাবা, মা, ভাই ও আত্মীয়স্বজনহারা তিনি এক সর্বহারা। স্বদেশ থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নাম, তাঁর আদর্শ। ছোট ছোট দুই সন্তান ঘরে রেখে তিনি পথে পথে ঘুরেছেন সেই আদর্শের খোঁজে। কখনো এক হচ্ছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কখনো বন্যাদুর্গত মানুষের সেবায়, কখনোবা পরিচয়হারা পথশিশুদের মানবেতর জীবনযাপন দেখে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। সেই সব উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার কথাই তো লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর রচনায়।
বিশিষ্ট কবি ও গবেষক বীরেণ মুখার্জী ‘শেখ হাসিনার সাহিত্যমানস’ শীর্ষক এক প্রবন্ধেও এই বেদনাবোধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যে যাদের নাম খ্যাতির শীর্ষে উচ্চারিত হয়, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই অপার দুঃখ কষ্ট বেদনাবোধের গল্প আছে, আছে জেল-জরিমানা এবং লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার চরমতম ইতিহাস। এমনই এক দিগন্ত বিস্তৃত দুঃখের সমুদ্রে বসবাস করে, ষড়যন্ত্র বিষাদ আর যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে সৃজনশীলতা সাক্ষর রেখে চলেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি শুধু সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়কই নন, একই সঙ্গে মমতাময়ী এবং সংবেদনশীল লেখকও।

সংবেদনশীল মনের অধিকারী হওয়ায় রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষ এবং পারিপার্শ্বকে তিনি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করতে পারেন। ‘এভাবেই রচিত হয় তাঁর লেখকসত্তা। হয়তো মহতের বিনয় প্রকাশ মনে হতে পারে, তবু নিজের লেখকসত্তা নিয়ে একটি বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনা যা লিখেছেন, খুবই প্রাসঙ্গিক বলে তা এখানে উল্লেখ করতে চাই।’ তিনি লিখেছেন, ‘কোনোকালে নিজে লিখব, এ কথা ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি ওই আদর্শ নিয়ে ২৮ বছর যাবত জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি। চারপাশের দেখা ঘটনা, মানুষের স্বপ্ন ও জীবনকে যেভাবে দেখেছি এবং জেনেছি, তাই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।’
লেখালেখির মাধ্যম বা উপাদান সম্পর্কে লেখক শেখ হাসিনার এই অকপট ঘোষণা মূলত তাঁর লেখকসত্তায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা এনে দিয়েছে। মানুষটি এমনই, যা বোঝেন তাই সহজে উচ্চারণ করেন এবং লেখালেখিতেও ফুটিয়ে তোলেন। প্রবন্ধ রচনার প্রথাসিদ্ধ নীতিপদ্ধতির বাঁধন আলগা করে তিনি একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে রাজনৈতিক সামাজিক বিষয়ের বিশ্লেষণমূলক আখ্যান তুলে ধরেন তাঁর প্রবন্ধে, আবার বিনয়ের সঙ্গে বলেন, হয়তো এগুলো প্রবন্ধই হয়ে ওঠেনি।
অথচ প্রথিতযশা প-িত অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর ক্লাসঘরের ছাত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা সঙ্গত কারণে রাজনীতিক রূপেই অধিকতর পরিচিত, কিন্তু লেখিকারূপেও শেখ হাসিনার অবদান যে উপেক্ষার নয়, তার কারণ তাঁর লেখা কোনো শৌখিন ব্যাপার বা অবসর বিনোদনের জন্য নয়। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই তিনি যে দুঃসময় অতিক্রম করেছেন, সে সময় লেখনি ধারণ সহজ ছিল না। তবু যে তিনি না লিখে পারেননি তার কারণ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে এবং পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সম্পৃক্তি থেকে। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে সংকলিত  প্রবন্ধাবলি, যা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা সংকলনে প্রকাশ হয়েছিল, তা থেকে একজন গভীর সংবেদনশীল লেখিকার অন্তর্দৃষ্টি এবং সচেতন মনমানসিকতার পরিচয় মেলে, যা গতানুগতিক রাজনৈতিক সাহিত্যে সচরাচর পাওয়া যায় না। 
এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশের রক্তখচিত বিপদসংকুল রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে এসে গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এবং তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষর অধিষ্ঠিত আছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে কখনো ক্ষমতার বাইরেও চলে আসতে পারেন, এমন কি চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মের কাছে মাথা নত করে একদিন তিনি পৃথিবীকে বিদায়ও জানাবেন; কিন্তু তাঁর যা কিছু লেখালেখি তা বাঙালি পাঠকের হৃদয়ের গভীরে টিকে থাকবে দীর্ঘকাল জুড়ে। এখানেই লেখক শেখ হাসিনার জিতে যাওয়া। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের দোলাচালে অনেক সফল রাষ্ট্রনায়কেরও স্থান হয় ইতিহাসের অন্ধকার পর্দার অন্তরালে, কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখকসত্তা ধ্রুবজ্যোতি হয়ে আলো ছড়াতেই থাকবে বাংলার আদিগন্ত আকাশে।

আমরা তো জেনেছি দেশের প্রতি দায়বোধ থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখকসত্তার উদ্বোধন ঘটেছে, কাজেই তাঁর সেই অসামান্য লেখকসত্তাই চিরকাল ঘোষণা করবে এই দেশ এবং দেশের মানুষের সত্যিকারে মুক্তির জন্য তাঁর ভাবনা এবং পরিকল্পনা কেমন ছিল, সে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁর সরকারের গৃহীত সমূহ পদক্ষেপের কথা বলবে রাষ্ট্র, বৈরী পরিস্থিতির কারণে তা অব্যক্ত থাকতে পারে কিংবা অপব্যাখ্যাও দেওয়া হতে পারে; কিন্তু লেখকের লেখকসত্তা কখনো মিথ্যাচার করে না বলেই তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ অনাগতকালের পাঠকের কাছে সত্যিকারের শেখ হাসিনাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করবে। লেখকসত্তার তো মৃত্যু নেই।
সব শেষে আমাদের ঐকান্তিক কামনা- দীর্ঘায়ু হোন জনগণমননন্দিত প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাজনৈতিক সত্তার পাশাপাশি তাঁর লেখকসত্তারও জয় হোক।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

×