ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নীলা কটেজ

আ. শ. ম. বাবর আলী

প্রকাশিত: ০১:১৩, ২১ এপ্রিল ২০২৩

নীলা কটেজ

নীলা ও মঈন

তাছাড়া নীলার কষ্টের কারণ-ই বা কি? নীলার তো অনেক কিছুই আছে। একজন মানুষের জীবনে কষ্টকে দূরীভূত করে একটা সুন্দর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য যা দরকার, সবইতো আছে নীলার। তবে তার কষ্ট কিসে? মঈনও আমার মুখের দিকে তাকালো। বললো, ‘তোমার জন্য নীলার মনে কষ্ট। যেন নীলার বার্তাবহ, নীলার একান্ত সচিবের মতো নীলার দেওয়া দায়িত্ব 
পালন করছে মঈন

মঈনের কাছ শুনলাম ওর কথা। 
মঈনের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল চিটাগং-এ। অফিসের কাজে মঈন চিটাগাং গিয়েছিল। সেখানেই নীলার সঙ্গে ওর দেখা। 
মঈন বললো, ‘খুব কষ্টে আছে নীলা।’
আমি মঈনের দিকে তাকালাম।
কারণ, কষ্টের কোনো পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা আমার জানা নেই। কষ্ট তো কত ধরনের আছে। অনেক কষ্টের মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি আছে। অনেক কষ্ট আবার গোপনে বুকের মধ্যে একটা ছোট্ট চিরস্থায়ী কুটুরি তৈরি করে নেয়। নীলার কষ্ট কোন ধরনের?
আর তাছাড়া নীলার কষ্টের কারণ-ই বা কি? নীলার তো অনেক কিছুই আছে। একজন মানুষের জীবনে কষ্টকে দূরীভূত করে একটা সুন্দর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য যা দরকার, সবইতো আছে নীলার। তবে তার কষ্ট কিসে? মঈনও আমার মুখের দিকে তাকালো। বললো, ‘তোমার জন্য নীলার মনে কষ্ট। যেন নীলার বার্তাবহ, নীলার একান্ত সচিবের মতো নীলার দেওয়া দায়িত্ব পালন করছে মঈন।
আমি মঈনের কথার কোনো জবাব দিলাম না। কি-ইবা জবাব দেওয়া যায়? মঈন যা বলছে, তা সত্যি না-ও হতে পারে। আমার আর নীলার জীবনের অতীত সব কাহিনী মঈন জানতো। চিটাগাং-এ নীলার সঙ্গে মঈনের হয়তো দেখা হয়েছিল। আলাপও হয়তো হয়েছিল। আমার প্রসঙ্গও হয়তো উঠেছিল। কিন্তু কি কথা হয়েছিল সে শুধু মঈনই জানে। এমনও হতে পারে, আমার কোনো প্রসঙ্গ নীলা শুনতে চায়নি। মঈনই জোর করে প্রসঙ্গটা তুলেছিল। নীলা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল।
আমাকে নীরব দেখে মঈন প্রশ্ন করেছিল, ‘নীলার কথা তোমার মনে পড়ে না রাজ?’
নত হয়ে আসা মাথাটা তেমনি রেখেই আস্তে করে নাড়িয়ে আমি বলেছিলাম, ‘না।’
মঈন বললো, ‘তোমাকে আমি মিথ্যে বলছিনে রাজ। নীলা তোমার কথা ভীষণভাবে মনে করে।’
নীরবতায় তখন আমি নিরুত্তর। 
মঈনও নীরব। 
আবার মঈনই নীরবতা ভাঙলো। বললো, ‘নীলা এখনও তোমাকে ভোলেনি। তোমাদের জীবনে যে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল, নীলা সেজন্য কাউকে দায়ী করে না। ওর ধারণা, ওর ভাগ্যটাই ওকে এমনি করে সারা জীবনের জন্য একটু দুঃখ-কষ্টের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে। দেখলাম, নীলা এখন দারুণ অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছে। অথচ আমি জানতাম, একদিন নীলা অদৃষ্টকে মোটেই বিশ্বাস করতো না। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক হতো। মাঝে মাঝ তোমরা দুজন দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়তে। আমাকেই তার সমাধান করতে হতো।’
আমি মঈনকে বাধা দিলাম। বললাম, ‘থাক মঈন, সে সব পুরনো কথা বলে আর লাভ কি? জগতে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। স্রষ্টার সৃষ্টিতেও তো দিন-রাত কত পরিবর্তন হচ্ছে। তা নিয়ে কেউ কি দোষারোপ করে? নাকি দোষারোপ করা চলে?’
এবার মঈন কেমন যেন একাগ্রভাবে আমার দিকে তাকাল। আমার অনেক কষ্টে লুকিয়ে রাখা দু’চোখের অশ্রুসিক্ততা মঈনের চোখে ধরা পড়ে গেল। নিজকে মঈন যেন কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল। অনেকক্ষণ সেও নিরুত্তর হয়ে রইল।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবে রাজ?’
আমি অসহায়ের মতো করে মঈনের মুখের দিকে তাকালাম। মঈনের চোখের ভাষা বুঝবার জন্য সাধনায় ব্রতী হলাম। নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে।
মঈন বলল, ‘তুমি একদিন চিটাগাং যাও। নীলাকে একবার দেখে এসো। 
মঈন বুঝি নীলার পক্ষ হয়ে আমার কাছে আবেদন পত্র পেশ করছে। নাকি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে? এবার মঈন একটা যেন অনুরোধের সংলাপ উচ্চারণ করল। বলল, ‘কিছু একটা বলো রাজ!’
আমি বললাম, ‘কি বলবো মঈন?’
মঈন বলল, ‘ওই যে বললাম, নীলাকে একবার দেখে এসো।’
আমি অসহায়ের মতো করে মাথাটা নিচু করে প্রশ্ন করলাম, ‘তাতে লাভ কি মঈন?’
এবার মঈন যেন একজন দার্শনিক হয়ে উঠল। দার্শনিকের সংলাপে বলল, ‘জগতে লাভ-লোকসানটাই কি সব রাজ?’ এর বাইরে কি আর কিছু নেই? তাছাড়া দীর্ঘদিন পর একে অন্যকে দেখবে আবার নতুন করেÑ এটাই বা কম কিসে? অনেক কিছু হারানোর পরে এটুকুকে তুমি তুচ্ছ ভাবো কেন রাজ?’
মঈন যেন এবার নীলার প্রতিনিধিত্ব করছে।
মঈনের কাছ থেকে নীলার ঠিানা নিয়ে একদিন আমি চিটাগাং গিয়েছিলাম। নীলার বাসা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি।
‘নীলা কটেজ’।
নামটা দেখে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থির যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠলো। নামটা দেওয়া তো আমারই। নীলাকে একদিন আমি বলেছিলাম, ‘খুব বড় প্রাসাদের আমাদের দরকার নেই। সমুদ্রের ধারে একটা সুন্দর ছোট্ট ঘর আমরা বানাবো। আমি তার নাম দেব ‘নীলা কটেজ’। সেখানে আমরা সারাদিন ধরে সমুদ্রের ঢেউ দেখবো। সাদা সাদা ঢেউগুলো আমাদের স্বপ্নকে অনেক অ-নে-ক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা দুজন হারিয়ে যাবো সেই অনন্ত নীল সমুদ্রের মাঝে।’  
আবেগাপ্লুত হয়ে নীলা আমাকে বলতো, ‘সমুদ্রের উপকূল থেকে অসংখ্য ছোট ঝিনুক কুড়িয়ে মালা গেঁথে আমার গলায় তুমি পরিয়ে দেবে। লক্ষ টাকা দামের অলংকারে চেয়ে সে মালা হবে আমার কাছে অনেক মূল্যবান।’
না, না, নীলা। সে সব কথাই এখন আর আমি মনে করতে চাই না। 
সমুদ্রের কাছেই নীলা ঘর বেঁধেছে। অসংখ্য সাদা ঢেউ এসে নীলার সে ঘরকে স্পর্শ করে যায়। সে ঢেউয়ের সঙ্গে নীলার কোনো স্বপ্ন মিশে যায় কি না, তা আমি জানি না। সেখানে স্বামীর পাশে বসে নতুন কোনো স্বপ্নে নীলা প্রত্যয়ী হয় কি না, তা-ও আমার জানবার কথা নয়। নীলার স্বামী সমুদ্রের উপকূল থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে মালা গেঁথে নীলাকে পরিয়ে দেয় কি নাÑ জানি না।
তবে ‘নীলা কটেজ’ আছে। কিন্তু সেই কটেজে নীলার সঙ্গীটি যে অন্য কেউ, সেখানে যে আজ আমার কোনো প্রবেশাধিকার নেইÑ এ যন্ত্রণা আমাকে অস্থির করে তুললো।
আমি ফিরে আসতে চাইলাম। নীলার সঙ্গে দেখা না করে আমি পালিয়ে আসতে চাইলাম। 
কিন্তু আমাকে পালাতে দিল না ছোট্ট মেয়েটি। 
চার-পাঁচ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। ফুটফুটে চেহারা, সারাটি চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ। দেখতে অনেকটা নীলারই মতো। নীলাও কি ছোটবেলায় এই ছোট্ট মেয়েটার মতো দুষ্টু ছিল? মেয়েটা কি নীলার কেউ? নাকি আমার দুর্বল মনে ওকেই নীলার প্রতিচ্ছবি ভাসছে?
বাইরে থেকে ও ছুটে এলো। নীলা কটেজের সামনে অপরিচিত আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে যেন কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তারপর অস্পষ্ট ভাঙা শব্দে আমার পরিচয় জানতে চাইল।
উল্টো ওকে আদর করে আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার নাম কি খুকু?’
ওর যেন অভিমান হলো। প্রতিবাদ জানিয়ে বললো, ‘উহু, খুকু না। আমার নাম  বন্যা। তুমি কিছুই জানো না।’
আমি আবার চমকে উঠলাম! একদিন নীলাকে আমি বলেছিলাম, ‘আমাদের ছেলে হলে নাম রাখব সাগর। মেয়ে হলে বন্যা। আমাদের দুজনার ভালোবাসা সাগর অথবা বন্যা হয়ে পৃথিবীটাকে ভাসিয়ে রাখবে। আমাদের ভালোবাসা অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবে অনন্ত সাগর আর অফুরন্ত বন্যার আনন্দলোকে।
আমার জীবনের আনন্দ নীলা তো আজ নেই। তবে কি নীলার জীবনের সব আনন্দ এখনো বেঁচে আছে? নাকি একটি বন্যার মাঝে নীলা তার সব হারানো আনন্দকে, তার হারানো ভালোবাসার ঐশ্বর্যকে ফিরে পেতে চায়? 
আমাকে নীরব থাকতে দেখে বন্যা প্রশ্ন করল, ‘কই, বললে নাতো, তুমি কে?’
বন্যার কথা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ওর মা। 
নীলাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।
কী মলিন চেহারা হয়ে গেছে নীলার! প্রাচুর্যময় হয়েও ওর সারাটি অঙ্গে কিসের এক বিষাক্ত ছাপ। 
হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো নীলা। মাথাটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যেন মমী হয়ে গেল। ওর সমস্ত শরীর থেকে যেন টপটপ করে ঝরে পড়ছে থোকা থোকা বেদনার আস্তরণ। 
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলা। কোনো এক গ্রিক দেবির মতো। অথবা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম অনুপম স্থাপত্য মোনালিসা। 
দীর্ঘদিন পরে নীলাকে দেখছি। নির্বাক হয়ে আমি দেখছি নীলাকে। 
নীলা কাঁদছে। 
আমিও প্রস্তর মূর্তি হয়ে নীলাকে দেখছি।
এ মুহূর্তে শুধু একটি কথা আমি নীলাকে জিজ্ঞ্যেস করতে চাই। একটা পরম সত্যি কথা নীলার কাছ থেকে আমি জানতে চাই।
কিন্ত কে যেন আমার কন্ঠটাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও আমি একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলাম না। 
নীলাও কি কিছু বলতে চায়? 
আমি জানি না। জানবার শক্তি আমার নেই।  
আমার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নীলা কাঁদছে। 
নীলার সামনে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বাকশক্তি হারিয়ে তার হৃত স্বপ্নকে আমি অবলোকন করছি।
আমরা দুজনাই অনুভূতিহীন একে অন্যের সম্মুখে। নীলার দু’চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে অশ্রুর বন্যা। আমার বুকের মধ্যে নির্মমভাবে অবরোধ সৃষ্টি করেছে দূরন্ত সাগরের সতেজ তরঙ্গ।
দীর্ঘদিন পরে আমরা আবার একে অন্যের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। সেই সেদিনের মতো। 
কিন্তু আজ আর আমাদের কারও সঙ্গে কোনো অনুভূতির প্রকাশ নেই। 
আমার মধ্যে নয়।
নীলার মধ্যে নয়।  
ভালোবাসার নতুন রূপের উপলব্ধিতে আজ আমরা দুজনাই যেন মর্মর মূর্তি হয়ে গেছি।

×