ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেহাতিরিক্ত

রফিকুর রশীদ

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ২৬ মার্চ ২০২৩

দেহাতিরিক্ত

ভোররাতের দিকে চেতনা ফিরে আসে নিয়ামতের

ভোররাতের দিকে চেতনা ফিরে আসে নিয়ামতের। ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে ঘরের মধ্যেই আছে নাকি অন্য কোথাও? এখানে এই বন্দিশালায় কদিন আছে মনে করতে চেষ্টা করে। সেদিন ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামায। নামাযের পর নিজাম মিয়ার মুখোমুখি। রমজান আলীও তেড়ে আসে। তারপর সব এলোমেলো। এই কলেজ-ক্যাম্প, সীমাহীন নির্যাতন। শুক্র-শনি-রবি-সোম... আজ কী বার? না, হিসেব মেলাতে পারে না। আর কিছুই মনে পড়ে না। কী আশ্চর্য!

আজ তার সারা শরীরের যন্ত্রণা গেল কোথায়? এরকম অনুভূতিশূন্য, নির্ভার, নিরবলম্ব মনে হচ্ছে কেন? সত্যিই সে বেঁচে আছে তো? ডান হাত দিয়ে বাম হাতের চামড়ায় চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কোথায় তার ডান হাত, কোথায় বাম হাত? পা দুটো? কোমরের নিচে তার পা দুটো আছো তো! ছুঁয়ে দেখতে সাধ হয়! না, সে সাধও পূরণ হবার নয়। হঠাৎ আবিষ্কার করে; সে যেন শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস হয়ে গেছে। পানিতে ভাসছে, তবু সারা শরীর শুকনো ঝরঝরে। দুচোখ রাগড়ে ভালো করে স¦চ্ছ চোখে জলে ভাসা রাজহাঁস দেখতে ইচ্ছে হয়।

চোখের পাতা মেলতে গিয়ে টের পায়, দুটি অক্ষিকোটরে তার একটিও চোখ নেই। এতক্ষণে নিয়ামতের ভারি ভাবনা হয়— হাতপা, চোখমুখ, মাথাম-ু কিছু নেই! তাহলে সে আছে কোথায়? সে কি তবে শরীর থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে— এও তাহলে সম্ভব? এ সময়ে তার ওস্তাদ আলেহীমের কথা মনে পড়ে যায়। কতবার তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে— দেহটা হচ্ছে খাঁচা, সময়মতো ওই খাঁচার বাইরে নিজেকে বের করে আনতে পারলেই মজা।

দেহ পড়ে থাকবে কাঠ-পাথর হয়ে, পড়ে পড়ে মার খাবে। পাবলিক বলো আর পুলিশ বলো— মারতে মারতে এক সময় হেদিয়ে যাবে, মুখে ফেনা উঠে যাবে তাদের— খাঁচার বাইরে থেকে তুই এসব ক্যাদ্দানি দেখবি, তবেই তো মজা! আমাদের এ লাইনে এই দেহতত্ত্বটাই আগে রপ্ত করতে হয়, গাধা কোথাকার!
নিয়ামত আর কিয়ামত, ছিঁটকে চুরি দিয়েই যাত্রা শুরু দুই ভাইয়ের। যত্রতত্র ধরা পড়ে। বেশুমার মার খায়। হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকে। হাজত খাটে মাসকে মাস। বেশ কবছর পর জেলখানার মধ্যেই পরিচয় হয় আলেহীম ডাকাতের সঙ্গে। ওস্তাদ মেনে তার কাছে দীক্ষা নেয় দুই ভাই। দেহতত্ত্বের দীক্ষা। এ লাইনে হাত পাকাতে হলে নিজের দেহের উপর ষোলআনা নিয়ন্ত্রণ আনা চাই। নইলে দেহটাই তোকে পদে পদে বিপদে ফেলবে। দেহটাই গুটিয়ে মুঠোর মধ্যে নিয়ে আয়, দেখবি তখন কত মজা! ওস্তাদ এইসব তত্ত্বকথা বলে আর হা-হা করে হাসে।

সেবার হাজত থেকে বেরুনোর পর ওস্তাদের শেখানো সূত্র ধরে দুই ভাই বহূদিন ওই বিশেষ ধারার দেহতত্ত্বের সাধনা করেছে। কিয়ামত অতিদ্রুত বেশ খানিক সাফল্য অর্জন করে। সেই সাফল্যে বেশি বেশি তড়পায়। ওস্তাদের ওপর বাটপারি করে ভাইকে শিক্ষা দেয়— মনোযোগটাই আসল কথা। যেকোনো একটা দিকে ভালো করে মনোযোগ দাও, আর সব দিক তুচ্ছ হয়ে যাবে।
সেই কিয়ামত চুরি-ডাকাতি ছেড়ে মনোযোগ দিল চোরাচালানের দিকে। ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ। মেহেরপুরে বসে তদারকি করে সে মোটা পার্সেন্টেজ পায়। বর্ডারের দুপারেই তার কড়া যোগাযোগ, তবু গত বছর বিএসএফ-এর গুলিতে সে নিকেশ হয়ে গেল। অতি বাড় বাড়লে তার এই হয়! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। না, নিয়ামত ওইসব বেহিসেবি ব্ল্যাকের কারবারে যায়নি। তার ধান্দা একটাই। রাতের গভীরে সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে এ-গ্রামে ও-গ্রামে গেরস্থবাড়িতে হানা দেওয়া। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল জুড়ে সারা দেশে কী যে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয়, নিয়ামতের এতদিনের ধান্দাপাতিতেও এলোমেলো ঝাপটা লাগে।

অবশ্য অল্পদিনের মধ্যে তার দুজন সঙ্গী সে ঝাপটা সামলে নেয়। দূর-দূরান্তের দেশত্যাগী মানুষ মেহেরপুরের সীমান্ত হয়ে পিঁপড়ের সারির মতো ভারতে পাড়ি জমাতে শুরু করলে তাদের পোটলা-পুটলি দেখে কালু এবং রুস্তমের চোখ চিকচিক করে ওঠ। ওরা বিপন্ন শরণার্থীদের ধমক-ধামক দিয়ে সোনাদানা কেড়ে নেয়। এ কাজে নিয়ামতের রুচি হয় না। লুটের মালের ভাগ দিতে এলে সে বরং রুস্তমকে শাসিয়ে দেয়— তোদের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, সাবধান! পাল্টা যুক্তি দেখাতে উদ্যত হয়েছে রুস্তম, কিন্তু নিয়ামতের লাল টকটকে চোখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে সুড়সুড় করে পালিয়েছে।
ঝিনেদা-চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত মিলিটারি চলে এসেছে শুনে মেহেরপুর এবং চারপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ছুটে যায় ভারতে। নিয়ামতের কোথাও যাবার ইচ্ছে হয় না। অতি শৈশবে বাপ-মায়ের হাত ধরে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো ভারত থেকে পালিয়ে এসেছিল বলেই হোক কিংবা আগের বছর ভারতীয় বি এস এফ-এর গুলিতে ভ্রাতৃ-বিয়োগের কারণেই হোক, নিয়ামত ভারতে যেতে চায় না। শহর থেকে মাইলখানেক দূরে রাস্তার পাশে তার বাড়ি, সারাদিন দেশত্যাগী মানুষের তোড়জোড় দেখে, নানান গুজব শোনে, রাত হলে বাড়ি ফিরে আসে।

এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর নির্দেশে সরকারি গাড়িতে করে বস্তা বস্তা টাকা ভারতে নিয়ে যাবার পর ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের বারান্দায় খুচরো টাকা-পয়সা কুড়ানোর মচ্ছব হয়, খাদ্যগুদাম থেকে পাল্লা দিয়ে গমের বস্তা সরাতে গিয়ে মালোপাড়ার রহিম বক্সের মাথায় বস্তা গড়িয়ে পড়ে কোমর ভেঙে যায়— এ সবই সে ঘুরে ঘুরে দেখে। দেখতে দেখতে তার হাসিও পায়। দৌলত মিয়া কেন ট্রেজারির তলানি কুড়াতে যায়, রহিম বক্স কেন গোডাউনের গম সরাতে যায়— এ সবের কিছুই মেলাতে পারে না বলে তার হাসি পায়।
সব গুজবের কবর দিয়ে এপ্রিলের ১৮ তারিখে মিলিটারি আসে মেহেরপুরে। আমঝুপিতে এবং ওয়াপদা মোড়ে গণহত্যা চালায়। হিন্দুপাড়ায় বেপরোয়া লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়। দীনু ডোম ভারতে না যাওয়ায় তার গর্ভবতী বৌ মালতি ধর্ষিত হয়। নিয়ামত বুঝতেই পারে না এসবের মানে কী! সারারাত শুয়ে শুয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে, সত্যি এ সবের মানে কী! কিছুতেই ঘুম আসে না চোখে। ওয়াপদা মোড়ের লাশগুলোর মধ্যে মদনডাঙ্গার তিনজনকে সে খুব স্পষ্ট চিনতে পেরেছে।

চিনেইবা কী করবে? লাশ টেনে বাড়ি পৌছে দেবে! চারদিকে জনমুনিষ্যির সাড়াশব্দ নেই, একা একা কটা লাশ টানবে? সন্ধ্যার আগে আগে সে কলা-ঝাড়ের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখে এসেছে এখানে-সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে হতভাগ্য মানুষের লাশ। এখনও চোখের পর্দা জুড়ে সেই লাশের দাপাদাপি, ঘুম আসে না।
ভোরের পাখিরা কলকণ্ঠে ডেকে উঠলে নিয়ামত বিছানা ছেড়ে উঠানে নেমে আসে। নিজের বাড়ি, তবু তার গা ছমছম করে। অকারণে দুবার গলা খাঁকারি দিয়ে উঠানে পায়চারি করে। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত বেশ কপাক পায়চারি করতে করতে ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে আসে চারদিক। নিয়ামত হঠাৎ কুয়োতলায় এসে ওজু করে বাড়ির পাশের মসজিদে উঠে গলা ছেড়ে আযান দেয়। বহুদিনের অনভ্যস্ততায় অথবা অন্তর্গত অন্য কোনো আতঙ্কে তার কণ্ঠস¦র ভেঙেচুরে যায়। যেনবা ভোরের বাতাসকেই আরো ভারি করে তোলো।

নিদ্রা অপেক্ষা নামায উত্তম— এই ঘোষণাতেও কারো ঘুম ভাঙে না। প্রতিদিন নামাযের আহ্বানে ঘুম ভাঙায় যে রমজান চাচা সেই লোকটিরও দেখা মেলে না। ভোরের আলো ফোটার পরও কারো সাক্ষাৎ না পেয়ে অবশেষে সে একাই নামাযে দাঁড়ায়। কিন্তু নামাযের নিয়ম-কানুন, সূরা-কালাম কিছুই মনে পড়ে না। সেই কোন শৈশবে বছরখানেক মক্তবে গিয়েছিল, তার পিতার খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেকে দেওবন্দ মাদ্রাসায় পাঠাবে, পাকিস্তানে চলে আসার পর আর কিছুই হয়নি। ওপারে যেটুকু দোয়া-দরুদ শিখেছিল, দিনে দিনে তাও নিঃশেষে গুলে খেয়েছে।

নামাযে দাঁড়িয়ে নিয়ামত শেষ পর্যন্ত কী করে! আল্লাহর কাছে হাত তুলে যা মনে আসে তাই বিড়বিড় করে বলে। অনেকক্ষণ হাত তুলে থাকে, তার যেন কথা ফুরায় না। এক সময় খুট করে একটুখানি শব্দ হতেই সালাম ফেরানো মতো করে ডান দিকে তাকায়। আর তখনই সে নিমের দাঁতন হাতে রমজান মুন্সিকে দেখতে পায়। হাতের দাঁতন তার মুখে ওঠে না, চোখে- মুখে প্রবল বিস¥য়, কি রে নিয়ামত, তুই? তুই আজান দিলি নাকি?
-হ্যাঁ চাচা, আমি। ঘাড়-মাথা-চুলকে নিতিবিতি করে আবদার জানায়— ভুলভাল হলে মাফ করে দিয়েন, চাচা।
-ভুল? বাসি থুতু ছিটিয়ে রমজান মুন্সি একটুখানি হেসে ওঠে, এ দুঃসময়ে তোর ভুল ধরবে কে? এ্যাঁ?
-না মানে, কোথাও কোনো মসজিদে আজান হলো না দেখে বুকের ভেতরে ছটফট করে উঠল চাচা, আমি আর বাড়িতে থাকতে পারলাম না। চলে এলাম।
রমজান মুন্সি দাড়ির গোছায় হাত বুলায়, বেশ করেছিস! আজ তো বড় মসজিদেও আজান হয়নি।
-না, কোথাও হয়নি।
ওই বড় মসজিদের আজানের পর আমি রোজ আজান দিই। রমজান মুন্সি একটু থেমে বেশ কয়েক বার দাঁতন ঘষার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে— তা বাপু গলা ছেড়ে আজান তো খুব দিলি, তোর ওজু ঠিক ছিল তো?
মুখে কথা না বলে নিয়ামত কেবল ঘাড় দুলিয়ে জবাব দেয়। এরপর আর কখনো সে পিছু ফিরে তাকায়নি। পাকবাহিনীর আক্রমণের পর শহর কিংবা গ্রাম সবই প্রায় বিরান হয়ে যায়। অধিকাংশ মানুষ ভারতে পাড়ি জমায়। শরাণার্থী নয় মুক্তিফৌজ হয়। নিয়ামতের দুচারজন ইয়ার বন্ধুও ওই দলে নাম লেখায়। কিন্তু নিয়ামত মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। সে দেশ ছাড়ে না, বাড়ির পাশের ওই মসজিদও ছাড়ে না।

মেহেরপুর কলেজ, কাজী নজরুল স্কুল, ভোকেশনাল জুড়ে পাকবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে রহমান মুন্সির কাজের পরিধি এবং ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মুসল্লির সংখ্যা হাতে গোনা আট-দশজন থাকে, তারা নিয়ামতের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়। দু-একজন আবার সন্দেহ-কুতকুতে চোখে তাকায়। টুপি-দাড়ি দ্যাখে, হাতে-তসবিহ-জোব্বা পোশাক দ্যাখে। নিয়ামত চোখ নামিয়ে নেয়। এইসব অবলম্বন নিয়ে সে নিজের দেশেই টিকে থাকতে চায়।
মাস দুয়েক পর রমজান মুন্সি রাজাাকার হবার প্রস্তাব দিলে নিয়ামত ভীষণ চমকে ওঠে, রীতিমতো ভিমরি খাবার যোগাড়। বহু কেঁদে কঁকিয়ে সে যাত্রা নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু সারারাত ঘুমোতে পারে না। গভীর রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মসজিদে যায়। পায়চারি করে। কাঠের তৈরি যে মিম্বারে বসে ইমাম সাহেব শুক্রবারের খুৎবা শোনান, সেইখানে ধপাস করে বসে পড়ে। খুব চিন্তা হয়, এতদিন পর রমজান চাচা কেন এই প্রস্তাব দিল? রাজাকারে লোক নিচ্ছে সেই কবে থেকে- এতদিন তো কেউ বলেনি। তাহলে?
শুক্রবার জুম্মার নামাযের পর খুৎবার ফাঁকে পাকিস্তানের অখ-তা এবং জাতীয় শত্রু প্রসঙ্গে আলোচনা উত্থাপিত হলে একজন মুসল্লি মন্তব্য করে, এশার নামাযের পর সে নাকি সেন্টুকে দেখেছে এই মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেতে।
সেন্টু?
রমজান মুন্সি যেন  আঁতকে ওঠে, সে তো দুষ্কৃতিকারী। তাকে ধরিয়ে দাওনি কেন?
সেন্টুর নাম করেছিল যে লোকটি, সে আর কিছুতেই মাথা তোলে না। কিন্তু সহসা এ কথা চাউর হয়ে যায়, ওই সেন্টু হচ্ছে নিয়ামতের চ্যালা। পিস কমিটির নেতা নিজামউদ্দীন চোখ কপালে তুলে গজরাতে গজরাতে এগিয়ে আসে, শালা ডাকাত, তলে তলে তল্লা বাঁশ। সকলেই নিঃসন্দেহ হয়ে পড়ে, সেন্টু নিশ্চয় নিয়ামতের কাছেই এসেছিল।

এরপর আর কালবিলম্ব না করে সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিয়ামতের ওপর। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনোই সুযোগ থাকে না তার। বরং এই উন্মত্ত গণপিটুনির ধাক্কাধাক্কিতে ইমাম সাহেবের মিম্বার একটুখানি সরে যেতেই তার তলা থেকে আচানক বেরিয়ে পড়ে ভয়ংকর সব আলামত। গ্রেনেড, বোমা এবং বেশ কয়েকটি কাটা রাইফেল।
এর পরের ঘটনা আর বিশেষ কিছুই মনে পড়ে না নিয়ামতের। জ্ঞান ফেরার পর টের পায় রক্তাক্ত মেঝেতে সে শুয়ে আছে। সারা শরীরে পাথুরে ক্লান্তি। কানে আসে নির্যাতিত মানুষের গোঙানি। কিন্তু তার গলায় কোনো স¦র ফুটছে না কেন? তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কার কাছে চাইবে পানি? চুরি-ডাকাতি করতে গিয়ে বেশ কবার গণপিটুনির শিকার হলেও এত কষ্ট তার হয়নি। হটাৎ দরজা খোলার শব্দে তার তৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে। সে কাৎরে ওঠে— পানি।

সহসা অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে যমদূত। প্যান্টের জিপার টেনে কলকলিয়ে পেসাব করে দেয় নিয়ামতের মুখে— পিয়ো শালে বাঙালি, শরাব পিয়ো। দাড়িগোঁফে ভর্তি মুখমন্ডলে তা ভরে যায়। চোখ বন্ধ করে সে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু যমদূত শুনবে কেন? চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে বসায়, হাতের ব্যাটন দিয়ে শুরু হয় পেটানো, সেই সঙ্গে উল্টোপাল্টে জিজ্ঞাসাবাদ, কারা আসে তোর কাছে? কারা? আর অস্ত্র কই? অস্ত্র নিয়ে এই একই ধারার প্রশ্ন অবিরাম চলে।
নিয়ামত মুখে চাবি এঁটে রাখে। নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, ভঙ্গি পাল্টে যায়। মাঝে মধ্যে রমজান মুন্সি এসে তদারকি করে যায়। মুখ ঘোরাতে না পেরে ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে বাটন নিয়ে নিজেই পেটাতে শুরু করে। মারতে মারতে এক সময় রমজান মুন্সিই হেদিয়ে পড়ে। মার খেতে খেতে এরই মাঝে একদিন ওস্তাদের কাছে শেখা দেহতত্ত্বের কথা মনে পড়ে যায় নিয়ামতের। সেদিন তার মলদ্বারে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে নির্যাতন করা হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় সারা শরীর কুঁকড়ে আসে।

ছটফট করে চেঁচিয়ে উঠলে তার উপরেই হান্টার। আর কতক্ষণ! এক সময় নেতিয়ে পড়ে দেহ, সে অজ্ঞান হয়ে যায়। ভোররাতে ধীরে ধীরে চেতনা ফেরার সময় তার মনে হয় সে অতি ছোট্ট শিশু, তিন-চারদিন পায়খানা হয়নি বলে দাদিবুড়ি তার পাছায় পানের বোঁটা গুঁজে দিয়েছে, অপেক্ষায় আছে কখন হয়... কখন হয়। নিয়ামত এক সময় ভড়াৎ করে অতিশয় দুর্গন্ধ বিষ্ঠা ঝেড়ে দিয়ে আরাম পায়। ঘনঘোর অন্ধকারেই সে যেনবা দেখতে পায়, তার পাছায় জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে দিচ্ছে যে সেপাইটি, দুর্গন্ধবিষ্টা ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে-মুখে। সে লাফিয়ে- ঝাঁপিয়ে একাকার।

নিয়ামতের তখন বেশ মজা লাগে। পরদিন তার পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝোলানো হয়। প্রথম দিকে ভীষণ কষ্ট। দেহের ভারসাম্য রক্ষা করাই মুশকিল। বাজার থেকে মোরগ-মুরগি কিনে বাড়ি আনার সময় সবাই তো ওই রকম উল্টিয়ে ঝুলিয়েই নিয়ে আসে।
তুচ্ছ প্রাণী হয়েও ওরা তো বেশ শরীরের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। এ কথা ভাবতেই নিয়ামত ঝুঁটিঅলা বদরাগী মোরগ হয়ে যায়। পাখা ঝাপটিয়ে, পায়ের নখে আঁচড়ে, ধারাল ঠোঁটে ঠুকরে-খুবলে একশেষ। পরদিন আবার কৌশল পাল্টায়। ঝুলন্ত অবস্থায় গরম পানির বালতিতে মাথা চুবিয়ে দেয়। জোর করে পানির মধ্যে চেপে ধরে রাখে। পানিতে বিন্দু বিন্দু ভুড়ভুড়ি ওঠে। নিয়ামত তখন তালপুকুরের অথৈ পানিতে সাঁতার কাটে-ডুবসাঁতার। শৈশবের অতি চেনা বিশাল পুকুর।

একবার ডুব দিলে সঙ্গীরা সহজে কেউ খুঁজে পায় না। কালো মিশমিশে পানিতে তলিয়ে যায়। সবাইকে চমকে দিয়ে ভোঁস করে ভেসে ওঠে বিশ হাত দূরে। দুহাতে পানি ছিটিয়ে দেয় সঙ্গীদের গায়ে। কিন্তু সেদিন বালতির ভেতর থেকে মাথা তুলতেই দেখতে পায় শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে রমজান মুন্সি। চোখে-মুখে গরম পানির ছিটা পড়তেই দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে-‘শালা শুয়োরের বাচ্চা।’
এভাবে একদিন, দুদিন, তিনদিন, এক সপ্তাহ পার হতে হতে এক সময় নিয়ামতের দেহতত্ত্বের সাধনা পূর্ণ হয়।

ধীরে ধীরে যতই চেতনা ফিরে আসে, ততই মনে হয় দেহের খাঁচা থেকে তার মুক্তি ঘটেছে ক্রমশ। দিব্যি সে বেরিয়ে আসছে খাঁচা থেকে। ওই তো আদিগন্ত সবুজ মাঠ। এই সবুজের হাতছানি সে উপেক্ষা করবে কী করে? হঠাৎ বুটের শব্দে সে সচকিত হয়। একা নয়, কয়েকজন। অচেনা ভাষার টুকরো টুকরো সংলাপ শোনা যায়। কী বলছে ওরা? রমজান মুন্সি খতম? মুক্তিবাহিনীর কাজ? নিয়ামতের ভারি আনন্দ হয়। প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করে। দরজা খোলার শব্দ হয়।

গটমট করে এগিয়ে আসে ওরা। নিয়ামতের বোধশূন্য দেহে লাথি কষে শুরু করে নির্যাতন। বুট জুতোয় পিষে দেয়। থেঁতলে দেয়। বেয়োনেট বাগিয়ে তেড়ে আসে একজন। অথচ এদের গলদঘর্ম আয়োজন দেখে নিয়ামত ভেতরে ভেতরে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে। ভোরের আলোয় তার সে হাসি সবুজ ধানের কচি পাতায় ঢেউ খেলে যায় নেচে নেচে।

×